মোহাম্মদ ইলিয়াস :
বাংলাদেশে বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা জানেন?
সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা আর অন কনভেনশনাল সব পদ্ধতি মিলিয়ে প্রতি বছর কী পরিমাণ প্রার্থী চাকরির বাজারে ঢুকছে জানেন?
সরকারী খাতে প্রতি বছর ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড এবং ফোরথ ক্লাস মিলে কর্মসংস্থান হয় কতজনের জানেন?
- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরীপ অনুযায়ী 1st-4th class মিলে সংখ্যাটা এক লাখ ৫৬ হাজার।
মেডিকেল সেক্টর দিয়েই উদাহরণ দিই।
দেশে প্রতিবছর এমবিবিএস ডাক্তার বের হচ্ছে কী পরিমাণ?
বিসিএস হেলথে গড়ে প্রতি বছর কী পরিমাণ নিয়োগ হচ্ছে
তাইলে প্রতি বছর কমসে কম ৮ হাজার ডাক্তারের সরকারী খাতে কোন চাকরী নেই।
এই ভাবে দশ বছর চলতে গেলে ৮০ হাজার ডাক্তারের সরকারী কোন চাকরী থাকবে না।
প্রাইভেট সেক্টরে যদি প্রত্যাশানুযায়ী কর্মসংস্থান তৈরি না হয়, তাইলে এই বিশাল সংখ্যক চিকিৎসকের কর্মসংস্থান কীভাবে হবে?
মেডিকেল সেক্টরে প্রাইভেট জবের সুযোগ মোটামুটি প্রচুর।
অন্যান্য খাতে?
কয়েকটা পত্রিকার নিউজ দেখেন
৪৭% স্নাতক বেকার।
প্রতি পাঁচজন বেকারের মধ্যে দুজন উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে সম্পূর্ণ বেকার ৩৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ সার্বক্ষণিক চাকরিতে, ১৮ দশমিক ১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত।
আসলে বাংলাদেশে বেকারত্বের ভয়াবহতা জানতে কোনো জরিপের প্রয়োজন হয় না। বিসিএস ক্যাডার সার্ভিস কিংবা অন্য কোনো খাতে একটি শূন্য পদে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা দেখলেই অনুধাবন করা যায়।
ভিন্ন চিত্র দেখুন।
সরকারী চাকরীতে বেতন ভাতা দ্বিগুণ করার পর মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং আর বিশ্ববিদ্যালয়ের তামাম মেধাবীরা ছুটছে বিসিএস জব করতে।
দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের এখন একটাই স্বপ্ন – সিভিল সার্ভিস।
পড়াশোনা করেছে রসায়ন বিজ্ঞানে, বিসিএস এ কাজ করতেছে এসি ল্যান্ড হিসেবে।
পড়াশোনা করেছে পদার্থ বিজ্ঞানে, বিসিএস জব উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে।
গ্রাজুয়েশন – মেডিকেল সাইন্সে, বিসিএস জব সহকারী পুলিশ কমিশনার হিসেবে।
গ্রাজুয়েশন বুয়েট থেকে, বিসিএস জব ডেপুটি কমিশনার হিসেবে।
এমনিতেই দেশের শিক্ষাখাতের অবস্থা নাজুক। প্রশ্ন ফাঁস আর I am GPA 5 এর জোয়ারে শিক্ষার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, সেখানে মেধাবীতম একটা অংশ যদি নন টেকনিক্যাল ফিল্ডে চলে যায়, টেকনিক্যাল ফিল্ড কে চালাবে?
দেশে গড়ে উঠা শিল্প কারখানা, আবাসন সেক্টর, স্থাপত্য নির্মাণ, চিকিৎসা, নগর ব্যবস্থাপনা এসব টেকনিক্যাল সেক্টর কাদের দিয়ে চলবে তাহলে?
অবশ্যই বিদেশীদের দিয়ে।
এই দেশের ফ্লাইওভার কি এই দেশের ইঞ্জিনিয়াররা বানাচ্ছে?
পদ্মা সেতু কি এই দেশের ইঞ্জিনিয়াররা বানাচ্ছে?
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি দেশীয় সিইও রা চালাচ্ছে?
শিক্ষার মানবনমনের সাথে সাথে বাড়ছে বিদেশীদের দৌরাত্ম্য।
সিনিয়র কয়েকজন বিদেশীদের সমান বেতন, তাদের দশগুণ বেশি সংখ্যক জুনিয়র এক্সিকিউটিভরা ও পান না।
মেডিকেল সেক্টরের অবস্থা আরো ভয়াবহ।
বড় বড় কর্পোরেট গুলি এখনো চিকিৎসা সেক্টরে বিনিয়োগ করে নাই।
এখনো বসুন্ধরা গ্রুপ, হা-মীম গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেঙ্গল গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ......... এরা হেলথ সেক্টরে উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ করে নিই। এরা যখন এই সেক্টরে বিনিয়োগ করবে, তখন তারা কিন্তু এদেশের কাউকে সিনিয়র কোন পোস্টে নিবে না। কনসালটেন্ট নিয়ে আসবে ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর থেকে। আর আমাদের ডাক্তারদের কাজ করাবে ডিউটি ডাক্তার/মেডিকেল অফিসার/রেজিস্ট্রার হিসেবে।
সমাধান কী?
দেশের বাইরে চলে যাওয়া?
মেডিকেল কলেজের সংখ্যা কমানো?
কোয়ালিটি ডেভেলপ করা?
ভারতের ছেলেমেয়েরা যখন বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সিইও হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, এবং হচ্ছে;
Sundar Pichai, CEO of Google
Satya Nadella, CEO of Microsoft
Shantanu Narayen, CEO of Adobe
Francisco D’Souza, CEO of Cognizant
Rajeev Suri, CEO of Nokia
Sanjay Kumar Jha, CEO of Globalfoundries
Dinesh Paliwal, chairman and CEO of Harman International
George Kurien, CEO of NetApp
Indra Nooyi, chairperson and CEO of PepsiCo
Ajay Banga, president and CEO of MasterCard
Piyush Gupta, CEO of DBS Group
Ivan Manuel Menezes, CEO of Diageo
Rakesh Kapoor, CEO of Reckitt Benckise
তখন আমাদের সর্বোচ্চ মেধাবীরা ভাবছে কবে একজন বিসিএস ক্যাডার হয়ে জীবন ধন্য করবো! কবে একটি সরকারি ব্যাংকের এডি, ডিডি হবো?
স্বপ্ন দেখানোর আর স্বপ্ন দেখার মানুষের বড্ড অভাব দেশটাতে।
ফলাফল নিজের চোখেই দেখছেন।
১। আমাদের সব সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন ৫৪ হাজার কোটি টাকা। আর এদেশে চাকুরী করা ৮-১০ লাখ বিদেশিদের আমরা বেতন দিচ্ছি প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা!
২। দেশের কয়েকশত প্রতিষ্ঠানের সিইও ভারতীয়! আর আমরা সেখানে তাদের অধীনে দৌড়াদৌড়ি করছি।সিনিয়র কয়েকজন বিদেশীদের সমান বেতন, তাদের দশগুণ বেশি সংখ্যক জুনিয়র এক্সিকিউটিভরা ও পান না।
৩। ভারতীয়দের ১০০ সিইও সারা দুনিয়া থেকে যা আয় করে, আমরা লাখ লাখ শ্রমিক পাঠিয়েও সেই টাকা পাই না।
আমরা কবে দেশের এবং দেশের বাহিরের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোর সিইও তৈরি করবো?
কবে আমরা এদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সিইও হয়ে বসে থাকা বিদেশির জায়গাটা নিজের করে নিতে পারবো?
কবে দেশের সব ধরণের টেকনিক্যাল কাজ বিদেশীদের সাহায্য ছাড়া নিজেরা করতে পারবো?
দেশে কিন্তু দক্ষ জনশক্তি নেই!
দেশের ৩৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৯৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩টি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর বের হচ্ছে দুই লাখের বেশি আর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে বের হচ্ছে প্রতিবছর ৫ লাখেরও বেশি।
৭ লাখ শিক্ষিতদের একটাই কথা – I want to be a BCS cadre!
মেয়ের বাবাদের একটাই কথা – বিসিএস ক্যাডার পাত্র চাই।
সরি টু সে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে এক নম্বর কারন অপরাজনীতির কালো থাবা হলে দুই নম্বর কারন ই সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট সিস্টেম।
হাইয়ার এডুকেশন তথা ভার্সিটি-এডুকেশনকে ধ্বংস করে দিয়েছে এই সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট সিস্টেম।
গ্র্যাজুয়েটদের স্পেশালিস্ট স্কিল ভয়াবহ রকমের কম।
প্রতিবছর যারা বের হচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরির জন্য
ভানুয়াতু আর ভিয়েতনামের মুদ্রার নাম,
আফ্রিকার দীর্ঘতম নদের নাম,
ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাজত্ব করা রাণীর নাম
৪২০তম অস্কার জয়ী ভিলেনের নাম
এসব মুখস্থ করা শুরু করে দেয় আর চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণির অংক বই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সবচেয়ে জরুরি বই!
হায় সেলুকাস, নিজের সাবজেক্টের কোন খবর নেই, আর আজাইরা জিনিস নিয়ে টানাটানি।
বিসিএস এ যারা কোয়ালিফাইড হচ্ছে তাঁরা অবশ্যই যোগ্য, কিন্তু এক্সাম সিস্টেমের কারনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ইন্টেলেকচুয়ালি পঙ্গু একদল গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে।
গেজেটেড এবং নন গেজেটেড পদে সরকারি চাকুরিগুলো যেই পরীক্ষার মাধ্যমে লোক নিয়োগ দেয়, সেই পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ এইচ এস সি পাশ থাকলেই চলে।
উইথ ডিউ রেসপেক্ট, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য যে জ্ঞান দরকার সেটা এসএসসি বা বড়জোর এইচএসসি লেভেলের পড়াশোনা দিয়েই অর্জন করা সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষায়িত ডিগ্রি নেয়া বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হতে পারে না।
বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ার লক্ষ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়া।
ভার্সিটি লাইফে একাডেমিক পড়াশোনার কোন খবর নেই বরং বিসিএসের পড়া পড়ে৷
পড়বেই তো।
পড়াশোনা করবে রসায়নে, বিসিএস জব করবে এসি ল্যান্ড হিসেবে।
পড়াশোনা করেছে পদার্থবিজ্ঞানে, বিসিএস জব করবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে।
পড়াশোনা করবে মেডিকেল সাইন্সে, বিসিএস জব করবে পুলিশ কমিশনার হিসেবে
পড়াশোনা করবে বুয়েট থেকে, বিসিএস জব ডেপুটি কমিশনার হিসেবে।
গ্রাজুয়েশনের নামে চার থেকে সাত বছর সময় নষ্ট করার হেতু কী তাইলে?
রাষ্ট্রের কর্মচারী হওয়ার জন্য গ্রাজুয়েশনে পঠিত জ্ঞানের কোন উপযোগিতাই যদি না থাকে এসএসসি এইচএসসি পাশ করার পর পরই বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া উচিৎ। তাইলে তরুণদের এই বিশাল সময়, রাষ্ট্রের আর্থিক অপচয় পুরাটাই বেঁচে যাবে।
সরি টু সে, একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হওয়া উচিৎ এক একটা রিসার্স সেন্টার, দক্ষ জনশক্তি, নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, মাল্টি – সেক্টোরাল গবেষক আর দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী তৈরির আঁতুড়ঘর যেখান থেকে বের হবে হাজারো উদ্যোক্তা এবং একেকজন উদ্যোক্তা তৈরি করবে হাজারো কর্মসংস্থান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর তৈরী করা নয়, বরং নতুন নতুন ব্যাংকের উদোক্তা তৈরী করা।
বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণরা জবের ভাইবা দিবে কেন? তারা তো জবের ভাইবা নেওয়ার কথা।
জ্যাক মা - বানর এবং কলা তত্ত্ব আমরা জানি।
বানরের সামনে কলা আর টাকা রাখলে- বানর কলাই পছন্দ করে। কারণ- বানর জানেনা টাকা দিয়ে অনেক কলা পাওয়া যায়।
৭৫৩ কোটি মানুষের প্রত্যেককে চাকুরি আর উদ্যোক্তার দুটি অপশন অফার করলে-সাবকন্টিনেন্টের অধিকাংশই চাকুরি পছন্দ করে।
চাকরী মানে চাকর + ঈ প্রত্যয়।
অর্থাৎ চাকর হিসেবে থাকার দাসখত ঈ প্রত্যয় দিয়ে আমরা চাকরীতে ঢুকি।
চাকরী দেয় মজুরী আর উদ্যোক্তা পায় মুনাফা।
মজুরী কোনমতে চলার নিশ্চয়তা দেয়, কিন্তু উদ্যোক্তার উদ্যোগ তার জন্য বিগ ফরচুন তৈরী করে।
জ্যাক মা বলেন- সাবকন্টিনেন্টের মানুষজন কোনোদিনই চীনকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেনা কারন-চায়নীজরা যেখানে বড় বড় উদ্যোক্তা সেখানে ভারতীয়রা চায় যেকোনো ভাবেই একটা চাকুরি।
কেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থটলেস জেনারেশন তৈরী করছে?
সম্প্রতি ইউ এন ডি পি র গ্লোবাল নলেজ ইন্ডেক্সে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে। ৭টি ইন্ডেক্সের সমন্বয়ে গড়া গ্লোবাল নলেজ ইন্ডেক্সে বাংলাদেশ ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২তম। সাতটি সূচকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থান প্রি ইউনিভার্সিটি এডুকেশনে (৬৯তম) আর সবচেয়ে খারাপ ভার্সিটি এডুকেশনে (১২৯তম ১৩৮টি দেশের মধ্যে)
ইউ এন ডি পি র এই রিপোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অথর্বতা আর অযোগ্যতার আন্তর্জাতিক সনদ মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই পড়তে পারেনা, বিশ্ববিদ্যালয় তো গবেষক, উদ্যোক্তা আর পলিসি মেকার তৈরির জায়গা; নষ্ট অপরাজনীতি, এইচএসসি সমমানের বিসিএস ক্যাডার কিংবা অস্ত্রবাজ দলীয় ক্যাডার তৈরির আড্ডাখানা নয়।