মুক্তমন রিপোর্ট : গেল কয়েক দিন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরার করা একটি প্রতিবেদনকে ঘিরে সরগরম ছিল রাজনীতি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। প্রথম দিকে দেশীয় গণমাধ্যমগুলো চুপ থাকলেও পরবর্তীতে ঢালাওভাবে নিন্দা জানানো শুরু হয়। শুধু তাই নয়, সাংবাদিকদের অধিকার ও আন্দোলনের গঠিক সংগঠনও সেই গণমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে যখন সরকার একটু কোনঠাসা তখনই বাংলাদেশে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাণ্ডারদের একজন জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানায় সরকারের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)। তারা অভিযোগ আনে, ৷ বঙ্গবন্ধু হত্যায় পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন- এমন কারণে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
গত মঙ্গলবারের ওই সংবাদ প্রকাশের পর রাজনীতিতে নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় চলে এসেছে। বিষয়টিকে বিএনপি অন্য বিষয় থেকে দৃষ্টি সরাতে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে করা হয়েছে বলে দাবি করছে।
সিঙ্গাপুরে চিকিৎসারত দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সেখান থেকে টেলিফোনে বলেছেন, দেশের এখনকার পরিস্থিতি থেকে জনগণের দৃষ্টি সরানোর জন্য সরকার এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
"জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে করা হয়েছে। এ সরকারের যে অপকর্ম এবং দুর্নীতির যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিতে এটা করা হচ্ছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম, তিনি শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই বসে ছিলেন না, তিনি দীর্ঘ নয় মাস দেশের ভেতরে থেকে লড়াই করেছেন।"
ফখরুল আরো বলেন, "বীর উত্তম খেতাব তিনি (জিয়াউর রহমান) পেয়েছিলেন, স্বাধীনতার পরে শেখ মুজিবুর রহমানের যে সরকার, সেই সরকারই তাকে খেতাব দিয়েছিল। এখন সরকারের সেই খেতাব বাতিলের উদ্যোগ মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কলঙ্ক লেপন করা হলো।"
তবে সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলছেন, ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য নয়, ইতিহাসের স্বচ্ছ্বতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এবং ঐতিহাসিকভাবে যা সত্য, তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এদিকে জামুকার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘‘আমাদের কাছে পাঠালে আমরা দেখবো৷ আগে পাঠাক।’’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমার জানা মতে এর আগে মুক্তিযুদ্ধের কোনো খেতাব বাতিলের সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়নি।’’ আইনমন্ত্রী মনে করেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিল করতে নতুন কোনো আইনের প্রয়োজন হবে না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমান সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ তিনি জেড ফোর্সের কামান্ডার ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলেই তাকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়। এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব। এই খেতাব পেয়েছেন মোট ৬৮ জন। ১৯৭৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে খেতাবের তালিকায় স্বাক্ষর করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর এক পর্যায়ে সামরিক শাসক হিসেবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। এরপর রাষ্ট্রপতি হন এবং রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেন।
এদিকে, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলের মঙ্গলবারের ঐ বৈঠকে খোন্দকার মোশতাক আহমেদের নাম মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য 'স্মরণীয় বরণীয়' ব্যক্তি হিসেবে যে রাষ্ট্রীয় তালিকায় আছে, সেখান থেকে বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনি শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী, রাশেদ চৌধুরী ও মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়।
বৈঠকে বলা হয়, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করায় তার খেতাব বাতিল করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বলেন, ‘‘আমরা (জামুকা) জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন একটা কমিটি করে দিয়েছি। তারা বসে সিদ্ধান্ত নেবেন যে কিভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় তা বাতিল করা হবে। এর সঙ্গে আরো কারো নাম আসবে কিনা তা-ও তারা দেখবেন৷ এরপর আমরা আইন মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের জন্য পাঠাবো। জামুকা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরের বিষয় আইন মন্ত্রণালয় দেখবে।’’
বঙ্গবন্ধুর যে খুনিদের খেতাব বাতিল করা হচ্ছে তাদের সবাই দণ্ডপ্রাপ্ত৷ তবে জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের প্রস্তাব সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘‘কনভিক্টেড না হলেও এটা তো স্বীকৃত এবং সবাই জানে যে, জিয়াউর রহমান এবং খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এটা তো সর্বজনস্বীকৃত। সামাজিকভাবে তারা দোষী।’’
এদিকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবীব জানিয়েছেন বিষয়টির সঙ্গে তাদের ফোরাম যুক্ত নয়। তিনি বলেন, ‘‘জামুকা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। এই প্রক্রিয়ার সাথে আমি কখনো যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু আমি মনে করি, জিয়াউর রহমান ঐতিহাসিকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জেড ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তাকে বীর উত্তম খেতাব দেয়া হয়েছে।’’
‘‘কিন্তু পরকর্তীকালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়ে মুক্তিযদ্ধের আদর্শ, চেতনা এবং ইতিহাসের সাথে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে যেভাবে পুনর্বাসিত করেছেন, তাতে আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধের পর তাকে যে খেতাবটি দেয়া হয়েছে সেটা বহন করার ক্ষমতা বা সাধ্য তিনি রাখেন না।’’ দণ্ডিত হওয়া না হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘এটা জামুকা এবং সরকারের বিষয়৷ সেটা তারা চিন্তা-ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে৷’’
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব এবং সাবেক আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন মনে করেন, জামুকা এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রমাণ করলো তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছে না, সরকারের ইচ্ছায় কাজ করছে এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করছে। ‘‘জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের খেতাব দিয়ে গেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবা। পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকা কার কেমন সেই বিবেচনায় এটা বাতিল হতে পারে না। খেতাব বাতিল করে তাকে কি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্বীকার করা যাবে?’’
তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মুক্তিযুদ্ধের খেতাবও বাতিল করা ঠিক না। বিএনপি খেতাব বাতিলের উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এ বিষয়ে পার্টি সিদ্ধান্ত নেবে।’’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিবিসিকে বলেছেন, খেতাব বাতিলের সুপারিশের ব্যাপারে দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
জিয়াউর রহমানের বীর উত্তম খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের যে বৈঠকে, সেই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মল হক। কিন্তু মন্ত্রীর নেতৃত্বে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলেও বলা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত সুপারিশ হিসাবে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে এবং প্রয়োজনে মন্ত্রীসভাতেও বিষয়টা যেতে পারে।
আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের প্রধান এবং একই সাথে তিনি সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত থাকা এবং হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সুপারিশ করছে মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।
তিনি উল্লেখ করেছেন, এখন দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। "তিনি (জিয়াউর রহমান) বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন দূতাবাসে তাদের পদায়ন করেছেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের যারা প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছে, তাদের নিয়ে তিনি মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল, তা তিনি বাতিল করেছেন। সেজন্য তার খেতাব বাতিল করা হয়েছে" মি: হক বলেন।
কিন্তু শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনায় জড়িত থাকার যে অভিযোগ সরকার করছে, তা নিয়ে কোন মামলা হয়নি বা কোন আদালতে বিচার হয়নি-তাহলে কিসের ভিত্তিতে খেতাব বাতিলের কথা বলা হচ্ছে?
এই প্রশ্নে মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, "আইনের নিয়ম হচ্ছে, যখন কেউ মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুর পর কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে কোন রায় হয় না।"
তিনি আরও বলেছেন, "যেহেতু জিয়াউর রহমান মৃত্যুবরণ করেছেন, তাই আদালত তাকে কোন শাস্তি দিতে পারে না। এটা আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত বিধান।"
মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, কোন রাজনৈতিক চিন্তা থেকে বা কোন পরিস্থিতির কারণে খেতাব বাতিলের বিষয়টি আনা হয়নি।
তিনি আরও বলেছেন, "ইতিহাসকে বিকৃত করার জন্য নয়, ইতিহাসের স্বচ্ছ্বতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এবং ঐতিহাসিকভাবে যা সত্য, তা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।"
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী বলেন, "তিনি (জিয়াউর রহমান) যদি প্রমাণিত হন যে তিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে জড়িত নন, তাহলে হয়তো ব্যবস্থা হবে না। তবে তিনি জড়িত মর্মে আলোচনায় যা উঠে এসেছে, তাতে তার জড়িত থাকার বিষয়টিই প্রমাণ হয়। যাই হোক তারপরও আমরা দালিলিক প্রমাণ সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতেই রিপোর্ট তৈরি করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবো," যুক্ত করেন।