মুক্তমন ডেস্ক : নতুন প্রাইভেসি পলিসি প্রকাশ করার পরপরই হোয়াটস অ্যাপের বড় বাজার ভারতীয়রা তা ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সিগনাল আর টেলিগ্রামে যোগ দেয়ার হিড়িক পড়েছে।
ভারতীয়দের যোগাযোগে সবচেয়ে জনপ্রিয় এই অ্যাপটি তার ব্যবসা টেকাতে দেশটির প্রধান প্রধান খবরের কাগজগুলোতে পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ।
মোবাইল অ্যাপের ইনটেলিজেন্স ডেটা বলছে, জানুয়ারির ৭ তারিখে হোয়াটসঅ্যাপ তাদের নতুন প্রাইভেসি পলিসি সামনে আনার পর থেকেই ভারতের অন্তত বারো লক্ষ মানুষ 'সিগনাল' ও ১৭ লক্ষ মানুষ 'টেলিগ্রাম' অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন। অপরদিকে নতুন বছরের প্রথম সাত দিনেই হোয়াটস অ্যাপের ডাউনলোডের হার কমেছে ১১ শতাংশ।
ভারতকে যোগাযোগ অ্যাপের জন্য সবচাইতে বড় বাজার ধরা হয়। এখানে প্রায় ৫০ কোটি মানুষ অ্যাপ ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৩৪ কোটি ব্যবহার করেন হোয়াটসঅ্যাপ।
গত বৃহস্পতিবার সকালে হোয়াটসঅ্যাপ খোলামাত্র তাদের ফোনে পপ-আপ করে একটি মেসেজ, যাতে জানানো হয় হোয়াটসঅ্যাপ তাদের ইউজার ডেটা ফেসবুক ও তার প্রোডাক্টগুলোর সঙ্গে শেয়ার করে যাবে।
ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিংয়ের অধিকর্তা সন্দীপ সেনগুপ্ত বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রাইভেসির ক্ষেত্রে মানুষ যেগুলোকে মূল্য দেয়, যেমন এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন, ডেটা শেয়ার না-করা - এই সব ফিচার হোয়াটসঅ্যাপে ছিল বলেই কিন্তু মানুষ সেটা বেছে নিয়েছিল, এই অ্যাপটা এত জনপ্রিয় হয়েছিল। অন্য দিকে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য ফেসবুকের দুনিয়া জুড়ে মারাত্মক কুখ্যাতি। তাদের বিরুদ্ধে অজস্র মামলা হয়েছে, বিপুল জরিমানা হয়েছে - প্রাইভেসি ভায়োলেশনের ক্ষেত্রে তারা একেবারে হ্যাবিচুয়াল অফেন্ডার বলা যেতে পারে।
এখন দেখুন, হোয়াটসঅ্যাপ একটা অ্যাপ - যেটা চব্বিশ ঘন্টা, ৩৬৫ দিন আমাদের মোবাইলে লাইভ থাকছে, অ্যাক্টিভ থাকছে। তার মানে সে আমাদের যাবতীয় ডেটা অনেক বেশি করে অ্যাকসেস করতে পারছে।
কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ সেটা কারও সঙ্গে শেয়ার করবে না, এনক্রিপ্টেড রাখবে এই ভরসাতেই তাকে আমরা মোবাইলে স্থান দিয়েছিলাম। কিন্তু সে যখন একজন পুরনো অপরাধীর সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে, তখন কিন্তু অবশ্যই একটা ব্রিচ অব ট্রাস্ট হয়েছে বলে মনে করি, বলছিলেন সন্দীপ সেনগুপ্ত।
আর এই বিশ্বাসভঙ্গের পরিণতিতেই যে ভারতীয়রা হোয়াটসঅ্যাপের বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন, বিশেষজ্ঞরা সে ব্যাপারে মোটামুটি একমত।
যদিও ফেসবুকের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ ঠিক কী ধরনের ডেটা শেয়ার করবে, তা নিয়ে তাদের অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই - মনে করছেন দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদদাতা শ্রুতি ধাপোলা।
মিস ধাপোলার কথায়, হোয়াটসঅ্যাপ যেহেতু ফেসবুক গ্রুপ অব কোম্পানির অংশ - তাই এই বাড়তি ইন্টিগ্রেশন এক রকম অনিবার্যই ছিল।
রুমস, হোয়াটসঅ্যাপ পে-র মতো ফিচার দিয়ে ফেসবুক সেটা চালুও করে দিয়েছে, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপে আপনার চ্যাটের এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশনে কিন্তু হাত পড়ছে না। আবার বিজনেসেস অন হোয়াটসঅ্যাপ তাদের আর একটা বড় উদ্যোগ, যেটাকে ফেসবুক দারুণভাবে সাপোর্ট করছে।
মঙ্গলবার ভারতের বিভিন্ন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও হোয়াটসঅ্যাপ দাবি করেছে, তাদের নতুন নীতিতে ব্যক্তিগত চ্যাটের গোপনীয়তায় কোনওভাবে হাত পড়বে না - তা প্রযোজ্য হবে শুধু বিজনেস অ্যাকাউন্টের জন্য।
তারপরও সিগনাল বা টেলিগ্রামের দিকে ঝোঁকার প্রবণতা কিন্তু ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী।
দিল্লিতে টেক এক্সপার্ট রুবিনা শাপু বলছিলেন, "এত লোক একসঙ্গে সিগনাল ডাউনলোড করতে চাইছেন যে তারা বলেই দিয়েছে ভেরিফিকেশন কোড আসতে দেরি হতে পারে।"
"সিগনাল ও টেলিগ্রাম দুটোই ভাল - তবে টেলিগ্রাম সব চ্যাটের ক্ষেত্রে এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপশন অফার করে না, শুধু গোপনীয় চ্যাটের বেলায় করে।"
"সিগনালে আবার কিছু ফিচার নেই, যেমন হোয়াটসঅ্যাপের মতো গ্রুপ কলের সুবিধা এখনও সেটাতে নেই। তবে এই মুহূর্তে সিগনালেরই রমরমা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।"
সন্দীপ সেনগুপ্তও আপাতত সিগনালকে এগিয়ে রাখছেন, কারণ ভবিষ্যতে টেলিগ্রাম কোন পথে হাঁটবে, তাতে তার খুব বেশি ভরসা নেই।
তিনি বলছিলেন, "টেলিগ্রাম একটা প্রফিট-মেকিং অর্গানাইজেশন, ফলে আগামী দিনে তারা মুনাফার খোঁজে ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের রাস্তাতেই হাঁটবে কি না, তা বলা খুব মুশকিল।"
"তার ওপর এটা তৈরি করেছে রাশিয়া, পশ্চিমী দুনিয়া তাই সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখে। বিভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন আইএসপি টেলিগ্রাম অ্যাপকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে, সর্বত্র এটার ইজি অ্যাকসেস পাওয়াও বেশ কঠিন।"
"অপর দিকে সিগনাল-টা হল ওপেন সোর্স, নন-প্রফিট। এই অ্যাপটা চলে পুরোপুরি ডোনেশনের ভরসায়, দানের টাকায়।"
"তাতে সুবিধাটা হল, সিগনালকে কারও কাছে গিয়ে জবাবদিহি করতে হয় না কেন এই অ্যাপটা মুনাফা করছে না! কিংবা মুনাফা করার জন্য আগামী দিনে কী ধরনের স্ট্র্যাটেজি নিতে হবে!" বলছিলেন সন্দীপ সেনগুপ্ত।
গত সপ্তাহে টেসলার কর্ণধার ইলন মাস্কও সিগনালের হয়ে সওয়াল করেছেন - এবং তাতেও হোয়াটসঅ্যাপের ওপর মানুষের আস্থা টলেছে।
গোপনীয়তা রক্ষা নিয়ে কোটি কোটি ভারতীয়র ভরসা কীভাবে ফেরানো যায়, সেটাই এখন বিশ্বে তাদের সবচেয়ে বড় বাজারে হোয়াটসঅ্যাপের প্রধান দুশ্চিন্তা।