নওয়াজিশ শিউল
: ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ডে লাল কালি, রং দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে চট্টগ্রামে। প্রতিবাদের ধরনটা নতুন না কিন্তু এই কাজটা কী তাঁদের ছিলো? আইন তো আছেই।" ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, দপ্তরের নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দেন আদালত। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
পরে ২০১৪ সালের ২৯ মে আন্তমন্ত্রণালয় সভায় স্থানীয় সরকার বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মাধ্যমে এটি কার্যকর করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু কাগজে-কলমেই আটকে আছে সে সিদ্ধান্ত।" আর এখন ২০২০ শেষ হলো বলে। ব্যাপার খানা এমন
"আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না বইয়ের আইন বইয়ে থাকতে দিন"
এজন্যই মানুষ আইন হাতে তুলে নেয়।
এদেশে বাংলার শত্রু কে? পশ্চিমবঙ্গে যেমন বাংলার অস্তিত্ব লোপ করার মতো বহু নিয়ামক ছিল এবং আছে। সেরকম আক্রমণ ও বাঁধা কী বাংলাদেশের বাংলাকে সহ্য করতে হয়েছে?
পশ্চিমবঙ্গে এক সময় ইংরেজিতে কলকাতা লেখা যেত না। বিধান সভায় যখন ইংরেজি অক্ষরেও কলকাতা লেখার প্রস্তাব গৃহীত হয় এটার বিরুদ্ধে সেরকম হৈচৈ হয়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে বাংলা ভাষা প্রসারের জন্য বিভিন্ন দাবি প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবের দাবিপত্রে স্বাক্ষর ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সহ দুশো জনের
অবাক কান্ড হলো আনন্দবাজার পত্রিকা ১৪ জ্যৈষ্ঠ সম্পাদকীয়তে এর বিরোধিতা করে। এই প্রস্তাবকে
"পাগলের প্রলাপ" "মড়াকান্না" বলে উল্লেখ করে। ক্যালকাটার বদলে কলকাতা, আর ওয়েস্ট বেঙ্গলের বদলে পশ্চিমবঙ্গ এই পরিবর্তনে অনেকে শিবসেনার চক্রান্ত বলে চালিয়ে দেন। অনেকে এসব দাবীকে দূরদর্শনে হিন্দি অনুষ্ঠান বাতিলেরও চক্রান্ত বলেন।
সাইনবোর্ডের সমস্যাও সুনীলের সময় ছিল। কলকাতার অধিকাংশ দোকানপাটের সাইনবোর্ড ছিল। হিন্দি আর ইংরেজিতে। সুনীলরা দাবি জানালেন এতেও সমস্যা নাই আমরা চাই সাইনবোর্ডের পাশে ছোট করে হলেও বাংলা লেখা থাকবে। দোকানে দোকানে গিয়ে তাঁরা বুঝিয়েছেন। পরে একটু চাপ প্রয়োগে ঘটনাকে অন্যদিকে চালিয়ে দেওয়া হয়।
এখন আসল কথায় আসি বাংলাদেশে বাংলার বিরুদ্ধে তো এতগুলো হুমকি নেই। ভারতে না হয় বিভিন্ন ভাষার দেশ সেখানে যে যার রাজ্য অনুযায়ী ভাষা শিখবে। এমনকি কলকাতায় বাংলা না শিখে চালিয়ে দিতে পারবে। দুটো রাজ্য বাদে ভারতে সব রাজ্যে মাতৃভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
কিন্তু একমাত্র ভাষার দেশ বাংলাদেশে যদি এরকম অবস্থা দেখা যায় তখন বুঝতে হবে এই ভাষার জন্য বাঙালিরা নিজেই হুমকি। বাংলা-ইংরেজি মিশ্রিত অশ্লীল ভাষায় কথা বলা তরুণ-তরুণীরাই হুমকি।
এই দেশে সমস্যা সাইনবোর্ডের না। সমস্যা হলো মুখে। লাল কালি দিলে তাঁদের মুখে দেন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শুধু এই ভাষা সমস্যা নিয়ে আর সাইনবোর্ডে বাংলা নিয়ে চারটা প্রবন্ধ আছে। এক প্রবন্ধে বলেন, শুধু দাবী দিয়ে হবে না। সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। দরকার হলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা পাঠ বাধ্যতামূলক করতে হবে মিডিয়াম যেটাই হোক। বাঙালি ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বললে তাঁদেরকে প্রকাশ্যের উপহাস করতে হবে। যেসব মা-বাবা সন্তানদের বাংলা শেখাতে চায়না তাঁদের সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। যে-কোনও দোকানে, ব্যাঙ্কে, হোটেলে বাংলায় প্রশ্ন করলে যদি উত্তর না পাওয়া যায় তাঁদের চোখরাঙানির ভাষা বোঝাতে হবে।
দরকারে তিনি ভাষা পুলিশ গঠন করার কথা বলেন। এ নিয়ে একটা আলাদা প্রবন্ধও আছে। কানাডার মন্ট্রিলের কুইবেক অঞ্চলে প্রধান ভাষা হলো ফরাসি। সমস্ত হোর্ডিং-সাইনবোর্ডে ফরাসি লেখা বাধ্যতামূলক। ব্যবসায়ীরা এই নিয়ম মেনে চলছে কিনা তা দেখার জন্য ভাষা-পুলিশ আছে।
ভাষা পুলিশের প্রস্তাব খারাপ না। আমাদের দেশের সাইনবোর্ড থেকে ইংরেজি বাদ দিতেও বলছিনা। পাশে ছোট করে লেখা থাকতে পারে এখন যেমনটা বাংলা লেখা থাকে। কিন্তু ওই এক কথা সাইনবোর্ডের চেয়েও বড় সমস্যা বাঙালিতে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেই এর মুকাবিলা করতে হবে।
"সুনীলের তথ্যগুলো তাঁর প্রবন্ধের বই আমি কি বাঙালি' তে পাবেন"