এবনে গোলাম সামাদ : কয়েক বছর আগে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, ভারতে হিন্দু মেয়েরা তাদের গর্ভে কন্যাসন্তান এলে গর্ভপাত ঘটাচ্ছেন। ভারতে হিন্দু মেয়েরা আমাদের দেশের মুসলমান মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীন। গড়পড়তা আমাদের দেশের মেয়েদের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর। কিন্তু তারা চাচ্ছেন না কন্যাসন্তান। ভারতে কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তান হলো অনেক বেশি কাম্য। নারী-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে ভারতে অনেক কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে ধরা হচ্ছে না মেয়েরা ছেলেদের সমতুল্য। মায়েরাই ভাবছেন কন্যাসন্তানের চেয়ে পুত্রসন্তান হলো কাম্য। নারী-পুরুষের সমতা ও স্বাধীনতা নিয়ে তাই ভারতে উঠতে পারছে প্রশ্ন। প্রশ্নটার সমাধান এখনো হয়নি।
আমরা ভারতের কথা বলছি; কারণ, বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবী আছেন, যাদের কাছে ভারত একটা আদর্শ দেশ। তারা মনে করেন বাংলাদেশের উচিত হবে ভারতকে অনুসরণ করা। যতদূর জানি, বাংলাদেশের মেয়েরা গর্ভে কন্যাসন্তান এলে এখনো ভারতের মেয়েদের মতো গর্ভপাত ঘটানোর কথা ভাবছেন না। অন্য আর একটি বিষয়ও মনে আসছে এই প্রসঙ্গে। ভারতে এক দল নারী এখন হয়ে উঠেছেন ভাড়াটে মা (Surrogate mother)। তারা অন্যের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করছেন টাকার লোভে, আর জীবিকার প্রয়োজনে, মাতৃত্বের প্রাচীন মহিমা বিসর্জন দিয়ে। নারী স্বাধীনতা নিয়ে তাই সৃষ্টি হতে পারছে নানা বিভ্রান্তি। মনে করার কারণ আছে, এ রকম বিভ্রান্তি এ দেশেও সৃষ্টি হতে পারে। তাই এই প্রসঙ্গে রয়েছে কিছু ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গেলে একেবারেই গোড়া থেকে ভাবা দরকার। তা না হলে বিতর্ক থেকেই যাবে, কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হবে না।
অনেকে মনে করেন, ইসলামে নারী স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। কিন্তু ইসলাম চেয়েছে মেয়েদের বাঁচাতে। মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে নয়। ইসলাম-পূর্ব যুগে আরবে অভিজাত পরিবারে কন্যাসন্তান জন্মালে তাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। কিন্তু ইসলাম এই প্রথাকে বন্ধ করতে পেরেছে। কুরআন শরীফে বলা হয়েছে, কন্যাসন্তান ও পুত্রসন্তান হতে হবে সমআদরণীয় (সূরাহ-১৬ : ৫৮, ৫৯)। অনেকে মনে করেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া বাস্তবে কোনো স্বাধীনতা সম্ভব নয়। ইসলামে মেয়েদের পৃথক সম্পত্তি রাখার অধিকার দেয়া হয়েছে। দেয়া হয়েছে স্বাধীনভাবে ব্যবসায় বাণিজ্য করার অধিকার। তথাপি বলা হয়, ইসলাম হলো নারী অধিকারের পরিপন্থী ধর্ম, যা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতারই পরিচয়বহ। ইসলামে মেয়েরা বাবার সম্পত্তির অংশ উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারেন। যেটা অন্য অনেক ধর্মের আইনে পেতে পারে না। এক সময় ইউরোপে কোনো মেয়েকে ডাইনি বলে সন্দেহ হলে তাকে বিচার করে পুড়িয়ে মারার বিধান ছিল। ইংল্যান্ডে ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারার আইন রদ করা হয় ১৭৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। বাইবেলে মেয়েদের ডাইনি বলে সন্দেহ হলে শাস্তি দেয়ার বিধান আছে। যাকে নির্ভর করে খ্রিষ্টান ইউরোপে সৃষ্টি হতে পেরেছিল ডাইনি পুড়িয়ে মারার বিধান। কিন্তু কুরআন শরীফে এ রকম কোনো বিধান নেই। অথচ প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে, ইসলাম হলো একটি নারীবিদ্বেষী ধর্ম।
উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাদের বিধবাদের স্বামীশবের সাথে একই চিতায় জীবন্ত পুড়িয়ে মারতেন। এই প্রথাকে বলা হয় সতীদাহ। লর্ডবেন্টিং এই প্রথাকে রদ করেন ১৮২৯ সালে। ইংরেজ ক্ষমতায় না এলে এই প্রথা রোহিত হতো কি না সেটা বিতর্কেরই বিষয়। ইংরেজ শাসনের আগে মুসলমান রাজা-বাদশাহরা এই প্রথাকে নিন্দা করলেও হিন্দু প্রজারা বিদ্রোহ করবে, এই কথা ভেবে তারা রদ করতে পারেননি। আওরঙ্গজেব আইন করে ছিলেন, কোনো মেয়ে আসলে সতী হতে চায় কি না, সেটা উপযুক্ত রাজকর্মচারী গিয়ে জানবেন। তিনি যদি দেখেন কোনো বিধবা স্বামীর চিতায় জীবন্ত পুড়ে মরতে চান না, তবে তাকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এই আইন যথেষ্ট কার্যকর হতে পারেনি। তবে ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত আইন হতে পারে কার্যকর। গোটা ইংরেজ শাসনে এটা নিয়ে ইংরেজ প্রশাসন ঐতিহাসিকভাবে গৌরব করতেই পারে।
এক সময় হিন্দু শিবমন্দিরে ছিল দেবদাসী প্রথা। দেবদাসী বলতে বোঝাতো, মন্দিরের সাথে সংশ্লিষ্ট গণিকাপ্রথাকে। এ বিষয়েও ইংরেজ আমলে প্রবর্তিত হয় আইন। ব্রিটিশ শাসন হিন্দু সমাজজীবনের জন্য হতে পেরেছিল হিতকর। কিন্তু মুসলিমসমাজ জীবনের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের কোনো বিশেষ আইন করতে হয়নি। মুসলিমসমাজ জীবন ছিল অনেক অগ্রসর। এসব কথা বলতে হচ্ছে এই কারণে যে, অনেক হিন্দু বুদ্ধিজীবী এখন প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, মুসলমানেরা তাদের মেয়েদের যথেষ্ট সমাদর ও সম্মান প্রদর্শন করে না। কিন্তু এই অভিযোগ সত্য নয়। তার অনেক প্রমাণ দেয়া যেতে পারে। মুসলমান সমাজে হিন্দু সমাজের মতো বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না। মুসলমান সমাজে বিধবারা হয়ে ওঠেনি হিন্দু সমাজের মতো একটা সমস্যা। হিন্দু বিধবা মহিলাদের জীবনের সমস্যা নিয়ে ইংরেজ আমলে রচিত হতে পেরেছে অনেক উপন্যাস। সেটা খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়।
হিন্দু ধর্মের বিধান অনুসারে, ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনো বর্ণের (Cast) হিন্দুরা বেদ পড়ার অধিকারী নন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার কেবল ছেলেরাই বেদ পড়তে পারেন, ব্রাহ্মণ মেয়েরা নন। মেয়েদের জন্য বেদ পাঠ নিষিদ্ধ। কিন্তু ইসলামে মেয়েদের কুরআন পাঠ নিষিদ্ধ নয়। নিষিদ্ধ নয় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা। ইংরেজ আমলে শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলমান সমাজ নানা কারণেই কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। মুসলমান মেয়েরাও শিক্ষার ক্ষেত্রে হয়ে পড়েছিলেন অনগ্রসর। কিন্তু তা বলে তারা যে নৈতিক শিক্ষা পেতেন না, তা নয়। ধর্মের মাধ্যমে তারা পেতে পারতেন উন্নত মূল্যবোধ। যাকে ধরতে হবে শিক্ষারই অঙ্গ। অনেক মেয়েই ফারসি পড়তে পারতেন। জানতেন ফারসি লিখতে। রাখতে সক্ষম হতেন গৃহকর্মের সাধারণ হিসাব-নিকাশ। একেবারেই যে তারা কিছু জানতেন না, তা নয়। মুসলমান সমাজে চাওয়া হয়েছে মেয়েরা হবে সুমাতা ও সুগৃহিণী। ইসলামে নারীর মাতৃত্বরূপকেই প্রদান করা হয়েছে সর্বোচ্চ মূল্য। তাই ইসলামে বলা হয়েছে, মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। আর কোনো ধর্মে এ রকম বলা হয়েছে কি না তা আমাদের জানা নেই। ইসলামে নারীর মাতৃরূপকেই দেখা হয়েছে বড় করে।
বেগম রোকেয়া দিবস পালন করা হলো। এই দিবসে অনেকে বললেন, রোকেয়া ছিলেন এ দেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ। কিন্তু এই জাগরণ বলতে সঠিক কী বুঝতে হবে সেটা থেকে গেল অস্পষ্ট। পাশ্চাত্য শিক্ষাই একমাত্র শিক্ষা নয়। প্রাচ্যশিক্ষারও একটা মূল্য ছিল এবং আছে। সেটাকে খাটো করে দেখা যায় না। আমরা এসব কথা বলছি, কারণ রোকেয়া দিবসকে নির্ভর করে অনেকে এমন কথা বললেন, যা শুনে মনে হতে পারে, মুসলমান মহিলারা ছিলেন নির্বোধ। তাদের কোনো হুঁশজ্ঞানই ছিল না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। মুসলমান সমাজ চলেছিল তার নিজস্ব মূল্যবোধ নিয়ে। যার অনেক কিছুকেই উপেক্ষণীয় ভাবার কোনো যুক্তি আছে বলে মনে হয় না।
যা কিছু ইউরোপীয়, তাই যে ভালো, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। কেমন ছিল মুসলিম মেয়েদের সমাজজীবন, তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতাব্দীতে লেখা কোনো এক ইংরেজ মহিলার বিবরণ থেকে। তিনি বিয়ে করেছিলেন লক্ষনৌ শহরের একজন ধনী মুসলমান ব্যক্তিকে। তিনি ভারতে আসেন এবং বাস করেন সুদীর্ঘ ১২ বছর। ১২ বছর পর তার স্বামীর আকস্মিক মৃত্যু হলে তিনি ফিরে যান বিলাতে। এবং একটি বই লেখেন এ দেশের মুসলিম মহিলাদের জীবনধারা নিয়ে। তিনি বলেন, মুসলমান মেয়েরা পর্দা প্রথা মানে কিন্তু তা বলে যে গৃহে বন্দী জীবনযাপন করেন, তা নয়। মুসলমান মেয়েদের জীবন নিরানন্দ নয়। বরং উৎসবমুখর। মুসলমান মেয়েরা নিকট পুরুষ আত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে মেলামেশাকে মনে করেন আত্ম-অবমাননাকর। মেয়েরা মেশেন মেয়েদের সাথে। একে অপরের বাড়িতে যান, খাওয়া-দাওয়া, উৎসব করেন।
তাদের জীবন আমরা যতটা আবদ্ধ ও নিরানন্দময় মনে করি, তা মোটেও নয়। মেয়েদের জগৎ ও ছেলেদের জগৎ আলাদা। মেয়েরা তাদের আপন ভুবনে বিশেষভাবেই হলেন সক্রিয় ও কর্মমুখর। এসব হলো একজন ইংরেজ মহিলার কথা। বইটা আমার নিজের পড়ার সুযোগ হয়নি।
Thomas Patric Hughes-এর সঙ্কলিত Dictionary of Islam হলো ইসলাম সম্পর্কে একটি খুবই মূল্যবান গ্রন্থ। এই অভিধান থেকে এই উপমহাদেশের ইসলামের স্বরূপ সম্পর্কে অনেক কিছু অবগত হওয়া যায়। এই অভিধানে ওই ইংরেজ মহিলার লেখা থেকে বিস্তৃত উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়েছে, যা থেকে ধারণা করা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই উপমহাদেশে মুসলমান সমাজের মেয়েদের অবস্থান সম্পর্কে। বইটিতে ওই মহিলা বলেছেন, ‘আপন ভাইবোনদের সম্পর্ক হলো খুবই নিবিড়। ভাইয়েরা শুনে চলে বড় বোনদের উপদেশ।’ তাই বলা যায় না, মুসলমান সমাজ ছিল কেবলই পুরুষশাসিত। রোকেয়ার জীবনেও দেখতে পাই যে, তার ভাইয়েরা তার বিপদে এসেছেন এগিয়ে। বোনকে করেননি অবজ্ঞা। আত্মীয় পরিজন নিয়ে পরস্পরের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে চলেছে মুসলিম সমাজজীবন। এই সমাজজীবনকে তাই এখন অনেকেই যতটা হীন বলে প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, তা ছিল না।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, হিন্দুসমাজে বিধবা বিবাহ প্রচলিত করতে চান। বন্ধ করতে চান বহুবিবাহ। হিন্দুসমাজে বহুবিবাহের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু মুসলমান সমাজে ছিল। বিদ্যাসাগর এই দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। করেছেন এই দুই সমাজের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ। বিদ্যাসাগরকে বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রথম সমাজতাত্ত্বিক। যিনি মুসলমানসমাজকে অযথা খাটো করে দেখার কোনো প্রয়াস পাননি। বরং হিন্দুসমাজকে মুসলমান সমাজের সাথে তুলনা করে চেয়েছেন হিন্দুসমাজ কাঠামোর পরিবর্তন। মুসলমান সমাজে হিন্দুসমাজের মতো কোনো কুলীন ব্রাহ্মণ সমাজ ছিল না, যারা অগুনতি বিয়ে করতে পারতেন।
১৯১৭ সালে ঘটেছিল বিখ্যাত রুশ বিপ্লব। বিপ্লবীরা বলেছিলেন, মেয়েরা পুরুষের কথা শুনে চলতে বাধ্য হয়। কারণ তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। তাদের দিতে হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আর এর জন্য দিতে হবে বাইরে কাজ করার অধিকার। এতে হবে তাদের আয়, আর কমবে স্বামীর ওপর নির্ভরতা। থাকবে না পুরুষশাসিত সমাজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে ১৯৯১ সালে। কমিউনিস্ট দর্শনের দাপট আর আগের মতো নেই। কয়েক সপ্তাহ আগে উজবেকিস্তানে মুসলমান মেয়েদের বলতে শোনা গেল, উজবেকিস্তানে শরিয়াহ আইন চায়। কমিউনিস্ট শাসনামলের আইন বাতিল করতে হবে। শরিয়াহ আইন হলে স্বামীরা স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে বাধ্য হবে। বাধ্য হবে সন্তানকে ভরণপোষণ প্রদান করতে। নারী স্বাধীনতার নামে মেয়েদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে তাদের করতে হচ্ছে ভারী শ্রমসাধ্য কাজ। যেমন তৈরি করতে হচ্ছে ইমারত, পাথর ভেঙে নির্মাণ করতে হচ্ছে পথঘাট। তাদের খাটতে হচ্ছে বাড়িতে, খাটতে হচ্ছে বাড়ির বাইরে। কিন্তু পুরুষেরা এ রকম খাটনি মোটেও করতে চাচ্ছে না। তারা হয়ে উঠছে সংসারের প্রতি উদাসীন। হয়ে উঠেছে মেয়েদের শ্রমনির্ভর। কিন্তু শরিয়াহ আইন এ রকম নয়। শরিয়াহ আইন বলে, পুরুষকে খেটে খাওয়াতে হবে মেয়েদের। নিতে হবে ছেলেমেয়ের প্রতিপালনের ভার। তাই শরিয়াহ আইন প্রবর্তন করতে হবে। কমিউনিস্ট জীবন বিধান পুরুষকে করে তুলেছে দায়িত্বজ্ঞানহীন, আরামপ্রিয় ও ফুর্তিবাজ। এভাবে সমাজজীবন চলতে পারে না। মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে নারী স্বাধীনতার নামে অতিরিক্ত পরিমাণে কায়িক শ্রমের বোঝা। আমি বোখারা শহরে যাইনি। ক’দিন আগে আমার একজন অতি কাছের নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি গিয়েছিলেন সমরখন্দ ও বোখারা শহরে বেড়াতে। তার কাছে শুনলাম উজবেকিস্তানের মেয়েরা আওয়াজ তুলেছেন শরিয়াহ আইন প্রবর্তনের। জানি না, আমাদের দেশের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা এই বিষয়ে অবগত কি না। তারা চাচ্ছেন, ইসলামকে হেয় করে প্রগতিশীল হতে। কিন্তু দীর্ঘ কমিউনিস্ট শাসনে থাকার পর মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ার মুসলমান মেয়েরা এখন চাচ্ছেন শরিয়াহ আইনের প্রবর্তন। শতকরা কত ভাগ মুসলমান মেয়ে শরিয়াহ আইনের পক্ষে আওয়াজ তুলেছেন, আমরা তা জানি না। কিন্তু আওয়াজ একটা উঠেছে। এ সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন।
কমিউনিস্টদের অন্যতম বিখ্যাত গুরু ফেডরিক অ্যাঙ্গেলস ঊনবিংশ শতাব্দীতে the Origin of the Family, Private Property and the State নামে একটি বই লিখেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন নৃতাত্ত্বিক লিউইস হেনরি মরগানের Ancient Society (১৮৭৭) নামক গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে। অ্যাঙ্গেলস নৃতাত্ত্বিক মরগানের ওপর নির্ভর করে মনে করেছেন এক সময় সমাজে ছিল মাতৃশাসন (Matriarchy))। এরপর এসেছে পিতৃশাসন (Patriarchy)। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় স্ত্রীরা পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়ে পড়েছে স্বামীর দাসীতে। কিন্তু এখন বেশির ভাগ নৃতাত্ত্বিক মনে করেন, একটি বিষয় মানুষের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য, তা হলো অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর তুলনায় মানবশাবককে প্রতিপালন করে স্বাবলম্বী করে তুলতে অনেক বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। এ সময় সন্তান প্রতিপালনের জন্য জননীর প্রয়োজন হয় জনকের সহায়তা। এ জন্যই মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছে পরিবার প্রথা। কমিউনিস্ট পণ্ডিতেরা যেভাবে পরিবারপ্রথার উদ্ভব হয়েছে বলে ব্যাখ্যা দিতে চান, সমকালীন নৃতাত্ত্বিকেরা তার সাথে সহমত পোষণ করেন না। মানবসমাজ কোনো সময় মাতৃতান্ত্রিক ছিল না। অনেক সমাজে মায়ের দিক থেকে বংশ ধরা হতো।
কিন্তু পুরুষকে পালন করতে হয়েছে সংসারের মূল দায়িত্বভার। বিয়ে বলতে বোঝায়, যে ব্যবস্থায় পুরুষ নারীকে সন্তান প্রতিপালনে সাহায্য করে। মানুষ ছাড়াও অন্য অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রে জনককে সন্তান প্রতিপালনে জননীকে সাহায্য করতে দেখা যায়। যেখানে জনক জননীকে সন্তান প্রতিপালনে সাহায্য করে, ধরে নিতে হবে সেখানেই আছে বিয়ে ব্যবস্থা। কমিউনিস্ট পণ্ডিতেরা বিয়েকে যেমন পুরুষের দাসত্ব বলে মনে করেন, সে রকম মনে করার কোনো কারণ নেই।
ইসলামে বলা হয়েছে, রোজহাশরের ময়দানে প্রতিটি পুরুষকে ডাকা হবে তার মায়ের নাম করে। এর মধ্যে মায়ের প্রতি দেখানো হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। মাকে ইসলামে কখনোই ছোট করে দেখার চেষ্টা করা হয়নি। ইসলামে মেয়েদের মাতৃরূপকেই দেখার চেষ্টা হয়েছে সবচেয়ে বড় করে, হেয় করে নয়। বাইবেলে বলা হয়েছে, হাওয়া বিবির প্ররোচনায় গম খেয়ে হজরত আদমকে ছাড়তে হয়েছিল বেহেশত। আসতে হয়েছিল মর্তে। কিন্তু কুরআনে এ রকম কাহিনী নেই। কুরআনে বলা হয়নি, মেয়েদের বুদ্ধিতে পুরুষ বিপথগামী হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের বোঝানো হচ্ছে, ইসলাম মেয়েদের হেয় করে দেখে। কিন্তু প্রকৃত সত্য সেটা নয়। মেয়েদের কায়িক শক্তি কম। মেয়েদের জীবনে পুরুষের তুলনায় বার্ধক্য আসে তাড়াতাড়ি। মেয়েরা সন্তানধারণ ও প্রতিপালন করে। মানব শাবক মাতৃদুগ্ধ পান করে বেড়ে ওঠে। জৈবিক কারণে সমাজজীবনে নারী ও পুরুষের ভূমিকা কখনোই অবিকল এক হতে পারে না। ইসলাম এই পার্থক্যকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট