প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর অত্যন্ত মর্যাদাবান ও সম্মানিত একজন সাহাবি হযরত হাজর বিন আদি রা: ছিলেন বনু কিন্দি গোত্রের একজন। এজন্য তাকে হাজর বিন আদি আল কিন্দি নামেও ডাকা হতো।
হযরত আলি রা: এবং হযরত মুয়াবিয়া রা: এদের মধ্যে দ্বন্দ সংঘাতের সেই ক্রান্তিকালে হাজর বিন আদি রা: ছিলেন হযরত আলি রা: এর পক্ষে। তাঁর শাহাদাতের পররে সিরিয়া ভিত্তিক হযরত উমাইয়্যা রা: এঁর নেতৃত্বে উমাইয়্যাদের শাসনব্যবস্থা শক্তভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠা হওয়া শুরু করে।
যদিও হযরত আলি রা: হযরত আব্বাস রা: এইসব সম্মানিত সাহাবাদের অনুসারী ও আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় খেলাফতের ক্ষমতা পূনর্বিনা্যসের প্রচেস্টা চালু ছিল। এই প্রচেষ্টাই বেশ কয়েকবার রক্তক্ষয়ী আন্তকোন্দল ও সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে উম্মহকে। এ সময় অনেক দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকেও মাত্রারিক্ত বাড়াবাড়ি করা হয়েছে যার সুযোগ নিয়েছে রাজ্যের দূর দূরান্তে নিয়োজিত তাদেরই কর্মচারীবৃন্দ।
এরকম একটা সময়ে কুফার মসজিদে মসজিদে রাসুলুল্লাহ সা: এঁর সম্মানিত সাহাবি হযরত আলি রা: নাম উল্লেখ করে জুমআর খুতবায় অভিশাপ দেয়া শুরু হয়। ইসলাম তো বটেই, যে কোন স্বাভাবিক বুদ্ধি, সৌজন্যতা, ভদ্রতা ও ভব্যতার বিচারেও এ কাজটিছিল অত্যন্ত গর্হিত, অরুচিকর এবং অসৌজন্যতামূলক অভদ্র আচরণ।
একদিন কুফার মসজিদে এরকম একটা খুতবা চলার সময় প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর সম্মানিত সাহাবি হযরত হাজর বিন আদি রা: দাঁড়িয়ে যান এবং প্রতিবাদ করেন। তিনি আল কুরআন থেকে (সুরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াত) তেলওয়াত করেন;
হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্ব জনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁ চিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।
হযরত মুগিরা বিন শু'বা গভর্নর থাকাবস্থায় তিনি হযরত হাজর রা: কে সতর্ক করে দিলেও কোন কঠোর ব্যবস্থা নেননি তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু অচিরেই যিয়াদ বিন আবিহ (পরবর্তিতে যিয়াদ বিন আবি সুফিয়ান) তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে এলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটলো।
যিয়াদ জনৈক আবু বুরদা ইবনে আবু মুসা আল আশারি'র নিকট থেকে লিখিত অভিযোগ পেলেন এই মর্মে যে হযরত হাজর রা: স্থানীয় জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উস্কানি দিয়েছেন আর এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ করেছেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে যিয়াদ হযরত হাজর রা: ও তাঁর অনুসারীদের গ্রেফতার করে দামেশকে মুয়াবিয়া রা: এর কাছে পাঠালে সেখানে বিচারে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তারে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
এদের মধ্যে হাজর রা: এঁর নিজের পুত্রও ছিল। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে হযরত হাজর রা: তার নিজের পুত্রের দন্ড আগে কার্যকর করার অনুরোধ জানান। তিনি আশংকা করেছিলেন হয়তো তাঁর মৃত্যুদন্ড কার্যকর হতে দেখে পরবর্তিতে পুত্র হুম্মাম বিন হাজর প্রাণভয়ে জীবন বাঁচাতে মুয়াবিয়া রা: এর সাথে আপোষ করে হযরত আলি রা: এর উপরে অভিশম্পাত করতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। প্রার্থনা মতো তার পুত্রের মৃত্যুদন্ড আগে কার্যকর করা হয়, এর পরে আর সাতজন অনুসারীসহ তাঁর, এটা ছিল ৬৬০ খৃষ্টাব্দের ঘটনা।
সেই সম্মানিত সাহাবি হযরত হাজর রা: এর কবর ছিল দামেশকের সন্নিকটে আদরা নামক এলাকায়। সারা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য বুজুর্গদের মতো তাঁর কবরের উপরেও পরবর্তিযুগে গম্বুজ বানানো হয়েছিল, সেটাকে ঘিরে একটা মসজিদও গড়ে উঠেছিল।
সিরিয়াজুড়ে চলমান গৃহযুদ্ধের সুত্র ধরে বিগত ২০১৩ সালের ২রা মে সেই কবরকেই ধ্বংস করে দেয়া সালাফিপন্থী কট্টরবাদী ফ্রি সিরিয়ান আর্মির একটি শাখা যাবহাত আল নুসরাহ (Jabhat al-Nusra)। তারা কেবল সেই গম্বুজকেই ধ্বংস করেনি, এমনকি, কবর থেকে সাহাবি হযরত হাজর রা: এর লাশও তুলে বের করে এনে এক অজানা স্থানে নিয়ে তা দাফন করেছে।
এ এমন এক বর্বরতা, যা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। যদি বিষয়টা এমন হয় যে, কবরের উপরে সৌধ নির্মাণ না জায়েজ, তাই সেটা ভাঙ্গা হয়েছে, তবে সেটা নিয়ে কোন কথা থাকে না। কিন্তু উপযুক্ত কোন কারণ ছাড়াই কবরের ভেতর থেকে একজন মৃত ব্যক্তির লাশ তুলে নিয়ে তা সরিয়ে ফেলাটা কোন বিচারেই মেনে নেয়া যায় না।
বিষয়টা আরও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে যখন সে লাশটি প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর একজন সম্মানিত সাহাবির হয়।
মুসলমানদের মধ্যে সহিহ আকব্দিার নামে উগ্রবাদীতা, অসহিষ্নুতাকে প্রশ্রয় দিলে তা কোন পর্যায়ে যায় বা যেতে পার, তার উৎকৃষ্ঠ নমূণা। (ধ্বংসের পূর্বে ও পরে সাহাবির কবর এবং উত্তোলনের পর তাঁর অবিকৃত লাশ)