আব্দুন নূর তুষার : আমি কখনোই মদ্যপান ও ধূমপান করি না। তারপরেও এটা লিখছি এজন্য যে আমাদের দেশে প্রতি বছর মদ্যপানে মানুষ মারা যায়। গত কয়েক সপ্তাহে এটা অনেক বেড়েছে। অথচ এই বিষয়ে কোন যৌক্তিক আলোচনা নাই।
আমাদের দেশে এই নিয়ে এক ভন্ডামী চলছে দীর্ঘকাল।
আমাদের আইনে বলা আছে অ্যালকোহলিক বেভারেজ মুসলিম নাগরিকদের জন্য নিষিদ্ধ তবে স্বাস্থ্যগত কারণে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তার কাছ থেকে সনদ বা সার্টিফিকেট নিয়ে , মদ্যপানের লাইসেন্স নেয়া যাবে।
১. চিকিৎসা শাস্ত্রে কোনো অসুখের জন্য নিয়মিত ঔষধ হিসাবে মদ্যপানের বিধান নাই। তাই প্রতিটি এধরনের সার্টিফিকেট মিথ্যা ও মিথ্যা সার্টিফিকেট দিয়ে পাওয়া লাইসেন্সগুলি আদতে অবৈধ।
২. যে সকল চিকিৎসক এ ধরনের সার্টিফিকেট দিয়েছেন তারা মিথ্যা কথা লিখেছেন ও অন্যায় করেছেন।
৩. মদ জাতীয় পণ্য দেশে অল্প কয়েকটি ডিস্টিলারী তৈরী করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ক্যারিউ অ্যান্ড কোম্পানী। এটা সরকারী। সরকার নিজেই দেশের সবচেয়ে বড় মদ উৎপাদনকারী ও বিক্রেতা।
৪. দামী মদের উৎস আমদানী।
৫. অ্যালকোহলিক বেভারেজের মান নিয়ন্ত্রনের কোন বিষয় দেশে নাই। এটা খুব মজার যে বিদেশী সস ও মেয়নিজের জন্য বিএসটিআই সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু বিদেশী মদের জন্য কোনো বিএসটিআই সার্টিফিকেট লাগে না।
৬. দেশের অভিজাত হোটেল ও অভিজাত ক্লাবগুলিতে মদ বিক্রি হয়। তারা মেম্বারদের কাছে মদ বেচেন। এক্ষেত্রে কমপক্ষে ২০০ মেম্বারের লাইসেন্স করতে হয়। তার মানে প্রতিটি ক্লাব মদ বিক্রির জন্য মদ খায় এমন মেম্বার খোঁজেন অথবা মদ্যপানকারীরাই ক্লাবগুলি করেন।
৭. ঢাকার প্রতিটি দামী আবাসিক এলাকায় এখন ক্লাব আছে। কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অ্যালামনাইদের ক্লাব আছে যেখানে মদ বিক্রয় হয়। ক্লাবগুলির লাভের সিংহভাগ আসে মদ বিক্রি করে। প্রতিবছর এরা যতো মদ বেচে সেটা তাদের মোট লাইসেন্সপ্রাপ্ত মেম্বারদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে জনপ্রতি মদ খাওয়ার পরিমান পাওয়া যাবে। যেটা অবিশ্বাস্য। এর কারণ হলো এই মদ ক্লাবের বাইরেও পাচার হয়।
৮. তার মানে যদিও সংবিধানে বলা আছে মদ ও জুয়া নিষেধ, তারপরেও দেশে আইনের মধ্যে চিকিৎসার অজুহাতে মুসলিমদের কাছে মদ বেচা হচ্ছে।
৯. চিকিৎসার বস্তু হলো ঔষধ্ কিন্তু মদকে ঔষধ মনে করা হয় না। ঔষধ হলে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অনুমতি লাগার কথা। কিন্তু মদের অনুমতি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে মাদক নিয়ন্ত্রন অধিদপ্তর। এটাও এক মজার বিষয়। খায় ঔষধ হিসেবে কিন্তু বলে মাদক।
১০. এত কথা বলার কারণ হলো আইনী ভন্ডামীটি বোঝার চেষ্টা করা।
১১. অবিলম্বে এই আইনী ভন্ডামী বন্ধ করে একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা উচিত যেখানে বিরাট অংকের টাকা দিয়ে লাইসেন্স প্রতি বছর নিতে হবে এবং অগ্রীম আয়করও দিতে হবে। এই দেশে গাড়ী চালাতে বিরাট অংকের অগ্রীম আয়কর দিতে হয় কিন্তু মাতলামী করতে কর দিতে হয় না।
১২. ভন্ডামীর আরেক নমুনা হলো ডোম, চা বাগান শ্রমিক, ঝাড়ুদার, মুচি ও মেথরের জন্য মদের অনুমতি দেয়া আছে। সেখানে ধর্ম কোন বিষয় না অথবা ধরেই নেয়া হয়েছে কোন মুসলিম মেথর, মুচি বা ঝাড়ুদার হয় না।
১৩. কেবল মিথানল থাকলেই মানুষ মরে এটাও ঠিক না। অতিরিক্ত খেলেও মানুষ মরে।
সার্টিফিকেটের ভন্ডামী বাদ দিয়ে দেশে মদ্যপানের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করা উচিত এবং মদের মান পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত। ব্যক্তিগত লাইসেন্সের জন্য বিরাট অংকের অর্থ নেয়া উচিত । প্রতিবছর মদপানকারীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাদের কোনভাবেই ভারী যন্ত্রপাতি ও গাড়ী চালানোর লাইসেন্স দেয়া উচিত না। শুধু তাই নয় প্রতিরাতে ও বারের বাইরে চালকদের ব্রেদ অ্যানালাইজার দিয়ে পরীক্ষা করা উচিত।
এ এক অদ্ভুত দেশ যেখানে মদ হলো ঔষধ কিন্তু অনুমতি দেয় মাদক নিয়ন্ত্রন , ঔষধের দোকানে পাওয়া যায় না , পাওয়া যায় অভিজাতদের প্রতিষ্ঠানে ও বারে আর এটার কোন মান নিয়ন্ত্রন নাই। মানুষ মরলেও তার কোন বিচার নাই।
আবারো বলে দেই আমি এটা লিখলাম একজন চিকিৎসক ও নাগরিক হিসেবে , কারণ আমি চিকিৎসক হিসেবে মদের প্রেসক্রিপশন লেখা চিকিৎসকদের জন্য লজ্জিত আর নাগরিক হিসেবে মিথ্যা সার্টিফিকেট নিয়ে লাইসেন্স দেয়ার ভন্ড প্রক্রিয়ায় আইনের অপব্যবহার নিয়ে মর্মাহত।