নিভৃত সংগ্রাহক মানিকগঞ্জের লিয়াকত আলী খান
১৭০ টি দেশের বিরল মুদ্রা, ৫২ বছরের দুর্লভ টিকিট রয়েছে তার সংগ্রহশালায়
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ): মানুষ শখের বশে কত কি-ই যে করেন। মনের ভেতরের গুণগুলো অনেকেই সযত্নে লালন করেন নিভৃতে-নীরবে। ৬৫ বছরে পা দেওয়া তেমনি একজন ব্যতিক্রমী স্বপ্নচারী মানুষ লিয়াকত আলী খান। তার কর্ম পরিধিই তাকে এনে দিয়েছে আট-দশজন মানুষের চেয়ে ভিন্ন পরিচিতি। মানিকগঞ্জ জেলা শহরের পোড়রা এলাকায় তার বাড়ি।
লিয়াকত আলী খানের সংগ্রহের শুরুর কথা : ১৯৫৬ সালের ৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন লিয়াকত আলী। পড়াশোনা তাঁর খুব একটা করা হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা হয়নি তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের আগে জেলা শহরের বাজার সেতুর কাছে বাবা মাজেদ আলী খানের চায়ের দোকান ছিল। সে সময় শিশু লিয়াকত চায়ের দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতেন। তখন বয়স ৮ কি ১০ বছর।
একদিন বাড়ি থেকে বাবার চায়ের দোকানে যাওয়ার পথে ব্রিটিশ আমলের এক পয়সার একটি রৌপ্য মুদ্রা কুড়িয়ে পান। মহামূল্যবান ভেবে সযতেœ রেখে দেন। মুদ্রাটিকে মুল্যবান মনে করে বড়দের চোখ এড়িয়ে সেটি নিয়ে দূরদূর বুকে হাজির হয়েছিল স্যাকরার দোকানে । নাম ভূলে যাওয়া সোনা -রুপার সে ব্যাবসায়ী সেদিন কুড়িয়ে পাওয়া মুদ্রাটি ফিরিয়ে দিয়ে তাকে বলেছিল এটি কেনা যাবেনা ।
এমন আরো কটি জমলে তার পর এসো । এ ঘটনা থেকে তাঁর মনে চিন্তা আসে, কীভাবে আরও মুদ্রা জোগাড় করা যায়। যেই চিন্তা সেই কাজ। আশপাশের পরিচিত-অপরিচিত মানুষদের কাছ থেকে একটি-দুটি করে জোগাড় করতে থাকেন দেশ-বিদেশের ধাতব মুদ্রা। কিন্তু এরই মধ্যে কখন যে এসব মুদ্রার প্রতি মায়া জন্মেছিল, টের পাননি লিয়াকত আলী। এরপর থেকে মুদ্রা সংগ্রহ করা নেশায় পরিণত হয়ে গেল। প্রথম দিকে এসব মুদ্রা তিনি দোকানে সংগ্রহ করে রাখতেন।
বিরল মুদ্রা আর দুর্লভ লটারির টিকিট সংগ্রহ ঃ ১৭০ টি দেশের ৩ সহ¯্রাধিক মুদ্রা, কাগুজে নোট আর লটারির টিকিটের দুর্লভ সংগ্রহ করেন লিয়াকত আলী খান। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত সব লটারির টিকিটও সংগ্রহে রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। ‘মুদ্রা সংগ্রহকারী লিয়াকত’ নামেই তিনি মানিকগঞ্জবাসীর কাছে পরিচিত। পেশায় ব্যাবসায়ি ছিলেন।
গত বছর ৫-৬ ধরে অসুস্থ হওয়ায় মানিকগঞ্জ শহরে বাসায় পাখি ও তার সংগ্রহশালা দিয়ে কাটাচ্ছেন প্রায় পুরোটা সময়। ইচ্ছা ছিল সারা বিশ্ব ভ্রমন করবেন, আর্থিক অসংগতির কারনে সেটি আর হয়ে উঠেনি তাইতো তিনি দেশি-বিদেশী নোট, মুদ্রা সহ গত ৪৬ বছরে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত সব গুলো লটারির টিকিট সংগ্রহ করে বিশ্ব ভ্রমনের শখ মিটিয়ে যাচ্ছেন।
সহধর্মীনি মারা গেছে কয়েক বছর পূর্বে; পাখি আর সংগ্রহশালাই এখন তার জীবন। নিরাপত্তার কথা ভেবে কোথাও বেড়াতে যান না তিনি। ১৯৬৯ সালের ঘুর্ণিদুর্গতদের সাহায্যার্থে রেডক্রসের ১ টাকার লটারির টিকিট থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিক্রয়রত লটারির টিকিটও সংগ্রহ করেছেন তিনি। লিয়াকত আলী খানের দাবি ১৯৬৯ সালের পাকিস্থান থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের অনুমোদিত সবগুলো লটারির টিকিটতার কাছে আছে। তার বিশ্বাস, ধাতব মুদ্রার মতো অর্থনৈতিক মূল্য না থাকলেও এসব দেশের লটারির টিকিটের একটি ঐতিহাসিক মূল্য নিশ্চই আছে ।
পাখির জন্য ভালোবাসা : এই মুদ্রা সংগ্রাহকের ভালোবাসা আছে পাখির প্রতিও। সকাল ৫ টায় তার ঘুম ভাঙ্গে তার পাখির আওয়াজে। প্রতিদিন প্রায় সহ¯্রাধিক শালিক, দোয়েল, ঘুঘুসহ আরও কয়েক রকম পাখি ভিড় করে বাড়ির উঠানে খাবার খাওয়ার জন্য। লিয়াকত পাখিদের আপ্যায়ন করেন মুড়ি ও চানাচুর দিয়ে। দিনে দিনে পাখির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এ কাজের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পান তিনি।
লিয়াকত আলীর কথা : ১৯৭২ সালে তার সংগৃহিত সবকিছু চুরি হলেও আবার সে সংগ্রহের কাজ শুরু করেন। নানা জনে নানা কথা বলেছেন, গুরুজনেরাও করেছেন তিরষ্কার। উপহাস করতে ছাড়েনি অনেকেই তবুও তার নেশা কাটেনি। বরং নেশা ধরে গিয়েছিল সংগ্রহের। লিয়াকত আলী খান তার মুদ্রাসংগ্রহের এমন তথ্য দেয়ার পাশাপাশি জানান, বিরল মুদ্রার খোঁজ পেয়ে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রন্তে ছুটে গেছি।
এমন ও ঘটনা ঘটেছে পুরেনো ১ পয়সার তামার মুদ্রাও কিনেছে হাজার টাকা দিয়ে। আমার এ নেশার কথা দীর্ঘদিন গোপন রেখেছি। কিন্তু এক সময় বন্ধু বান্ধব, প্রতিবেশি আন্তীয়রা জেনে গেছেন। গোপন রাখা যায়নি। এতে আমার লাভই হয়েছে। এখন আমার হয়েছে আমার বন্ধু-প্রতিবেশিরাই বিভিন্ন দেশের কয়েন পেলে আমার জন্য তা সংগ্রহ করে রেখে দেয় বা আমার বাড়িতে পৌছে দেয়।
চেনা পরিচিত জনের বিদেশ থেকে দেশে ফেরার পথে সেসব দেশের নতুন পুরোনোমুদ্রা আমার জন্য নিয়ে আসেন। লিয়াকত আলী খান বিশ্বের সবগুলো দেশের মুদ্রা সংগ্রহ চেষ্টাকে নিজে নিজেই চ্যালেজ্ঞ হিসেবে নিয়েছেন । তার বিশ্বাস দু-এক বছরের মধ্যে তার সে স্বপ্ন পুরণ হবে। তার কাছে অনেক গুলোমুদ্রা আছে যেসব মুদ্রা কোন সময়ে কোন দেশে তা এখনও তিনি বুঝে উঠতে পারেনি।
অনেক কে সেসব দেখিয়েছেন ও কিন্তু কেউ তার রহস্য আজো ভেদ করতে পারেনি। আরবি, ফার্সি, কোনো ভাষার সংঙ্গে এসব মুদ্রার বর্ণ মেলে নি। বেশ কয়েকটি মুদ্রা আছে যেগুলো কোনো ধরনের কোনো কিছুই লেখানেই। ধাতব মুদ্রার সাথে তিনি শতাধিক দেশের কাগজের নোট ও সংগ্রহ করেছেন। এ সব নোটের মধ্যে স্বাধীন বাংলা দেশের নোটও রয়েছে।
লিয়াকত আলীর সহধর্মীনি মারা গেছেন। তিন ছেলে সাঈদ হোসেন খান সুমন, রাজীব হোসেন খান ও রাকিব হোসেন খান জেলা শহরে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাই এসব মুদ্রা নিয়ে স্বস্তিকর সময় কাটাতে চাইলেও তার পক্ষে তা দিন দিন কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সংগৃহীত মুদ্রার নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যেতেও মন টানে না তার। তার এ সংগ্রহ দেখতে কেউ না কেউ প্রায়ই বাড়িতে আসেন। দেখাতেও হয় কষ্ট করে। নিজ বাড়িতে এগুলোর জন্য প্রদর্শনী গ্যালারি, নিদেনপক্ষে উপযোগী শো-কেস, আসবাবপত্র প্রয়োজন- এসব উপলব্ধি করলেও আর্থিক সীমাবদ্ধতায় তা হয়ে উঠছে না তার।