জাহিদুল ইসলাম : ১৬ ডিসেম্বর ২০৪১। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ড। বিপুল সংখ্যক দর্শক। উপস্থিত আছে বিদেশী রাষ্ট্রদূত, সামরিক -বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ। উদ্বোধনী ভাষন দিতে মঞ্চে ওঠেছেন প্রেসিডেন্ট ড. শামস উদ দীন ইলিয়াস। সবাই জানে আজ তিনি জাতিকে নতুন কোন সুসংবাদ দিবে। কিন্তু কেউ নিশ্চিত না কি ঘোষনা আসতে পারে ইলিয়াস সরকারের পক্ষ থেকে।
গত ১০ বছর ধরে ইলিয়াস সরকার ক্ষমতায়। প্রতিটি বিজয় দিবসে ছিল চমক। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ যেমন অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন দেখিয়েছে, তেমনি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য বিপুল প্রশংসা অর্জন করেছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশ যেমন কমিয়ে এনেছে ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য তেমনি উদ্ভাবনী শক্তির রেংকিংয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে শীর্ষ দেশ দশের তালিকায়।
বিগত বিজয় দিবসে জাতি পেয়েছে অনেকগুলো সুসংবাদ। ২০৩১ সালে দেশের সব মানুষকে হেলথ ইন্সুরেন্সের আওয়ায় আনা হয়েছে, ২০৩২ সালে নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ ঘোষণা, ২০৩৩ সালে গবেষনা খাতে জিডিপির ১০ ভাগ বরাদ্দ ও ২০ টি বিগ বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ২০৩৪ সালে কৃষিখাতের জন্য ৫০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকী, ২০৩৫ সালে সবার জন্য আবাসন প্রকল্পের সফল সমাপ্তি। ২০৩৬ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ উদ্বোধন, ২০৩৭ সালে বিশ্বের টপ টেন অর্থনীতির ক্লাবে প্রবেশ, ২০৩৮ সালে ২ টি নিজস্ব বিমানবাহী রণতরী বঙ্গোপসাগরে কমিশন, ২০৩৯ সালে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর উদ্বোধন, ২০৩০ সালে নারীদের জন্য সবচেয়ে সুরক্ষিত দেশ ও সংখ্যালঘু অধিকার নিশ্চিতে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার।২০৩১ সালে কি সুসংবাদ আসতে পারে তার প্রতি ব্যাপক কৌতুহল জনগনের । বিশেষ করে আগত শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া উচ্ছাস।
উদ্বোধনী ভাষণে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে প্রেসিডেন্ট ইলিয়াস বলছেন, প্রিয় দেশবাসী, আজ আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী, হুসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম সহ আমাদের জাতির সব নেতৃবৃন্দদের। তাদের সবার অবদান রয়েছে জাতির উন্নয়নে। আপনারা জানেন, আমরা বিভেদের রাজনীতি থেকে বের হয়ে এসেছি ২ দশক আগেই। আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ন করতে কারো অবদানকেই আমরা খাটো করে দেখি না।
প্রিয় দেশবাসী আপনারা জানেন আমার যৌবনের একটি বিরাট সময় তুরস্কে কেটেছে। আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, রাজনীতি বিজ্ঞানের নয়। তবে সব সময় দেশকে নিয়ে ভেবেছি। দেশের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে ভেবেছি। আমাদের সময় তুরস্কে ছিল মুসলিম বিশ্বের জন্য এক মডেল। বিভিন্নখাতে তুরস্কের উন্নয়ন দেখলে তখন কল্পনা করতাম এই উন্নয়ন যদি আমাদের দেশেও করতে পারতাম। আমার বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথিবীর উন্নত দেশের তালিকায় ওঠে আসবে।
আজকের তরুনদের প্রতিও আমার আহবান, আগে নিজেকে প্রস্তুত করো, দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখো। শুধু উন্নয়ন নয়, বৈষম্য দূর করাও আমাদের বিজয়ের লক্ষ্য। আমরা তোমাদের রাজনৈতিক উদ্যেশ্যে ব্যবহার করতে চাই না। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আজ অতীতের নোংরা রাজনীতিমুক্ত। আমরা বিশ্বমানের গবেষনার পরিবেশ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছি।
আপনারা জানেন, বিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য ২০২৫ সালে আমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেই টাকার পুরোটা দিয়ে আমি একটি তহবিল তৈরী করেছি। যে তহবিল প্রতিবছর বাংলাদেশী ছাত্রদের বিজ্ঞান গবেষনায় তহবিল বরাদ্দ দিত। প্রথমে এটি আমার ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান থাকলেও তা উন্মুক্ত করে দিয়েছি সবার অনুদানের জন্য। অবশেষে আমাদের বুবিটাক আজ বাংলাদেশ সরকারের একটি স্বায়ত্বশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
গত ১০ বছরে আমাদের জাতির যা অর্জন, তার পেছনে ছিল বুবিটাকের গবেষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আল্লাহর রহমত।
আজকে আমি আপনাদের যে কথাটি মনে করে দিতে চাই গত ১০ বছরে জাতির যে উন্নয়ন, তা আমার একার প্রচেষ্টা নয়। জাতির প্রতিটি নাগরিকের অবদান রয়েছে এখানে। আমি হয়তো দুদিন পর ক্ষমতায় থাকবো না, থাকবো না এই পৃথিবীতে। আমার অনুরোধ আমার স্মরনে জাতির একটি টাকাও যেন নষ্ট না হয়। কোথাও আমার নামে কোন ভাষ্কর্য, প্রতিকৃতি অথবা আমার বিশালাকার ব্যানার বানিয়ে আমাকে স্মরন করার দরকার নেই। সত্যিই যদি আমি বিজয়কে অর্থবহ করতে আপনাদের কোন খেদমতের সুযোগ পেয়ে থাকি, আমাকে রাখবেন আপনাদের দুহাতের দোয়ায়। এতেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।
আজ আমি আপনাদের মনে করে দিতে চাই, আপনারা জানেন গত ১০ বছরে আমরা খাদ্যে স্বয়ং-সম্পূর্ন হয়েছি। আমরা প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসার নিশ্চয়তা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা, নিরাপদ অর্গানিক খাদ্যের নিশ্চয়তা, স্বাধীনভাবে ধর্মীয় অনুশাসনের নিশ্চয়তা, বাক স্বাধীনতা সহ জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার সবগুলো শর্ত পূরণ করতে পেরেছি। অ অর্জন আমার একার নয়, আমার দলেও নয়। এ অর্জন আপনাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার।
কিন্তু আপনাদের মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ বাংলাদের চেয়ে মহান। শুধু মাত্র এক লাখ ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে আমাদের জাতি সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের জাতি ছড়িয়ে আছে আসামে, পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, বিহারে, আন্দামান নিকোবরে। বিগত দিনগুলোতে আমরা ১ লক্ষ বাঙ্গালী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিয়েছি বাংলাদেশে। আমাদের ত্রান পৌছে গেছে সীমানার উপারে। এ বছর আমি ঘোষণা দিতে চাই আমাদের সীমানার বাইরে থাকা সব বাংলাভাষী পাবে ভিসা ফ্রি এন্টি ও ওয়ার্কপারমিট। বিশেষ পয়েন্ট পূর্ণ করা সাপেক্ষে আমরা ডুয়েল সিটিজেনশীপ দেব আমাদের বাঙ্গালীভাই বোনদের। এভাবে আমরা আন্তর্জাতিক সীমারেখা অক্ষত রেখেই একীভূত করে নিতে চাই সীমানার উপারে আটকে পড়া বাঙ্গালী জাতির সদস্যদেরও।
আরেকটি ঘোষণা, এ বছর আমাদের বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্টের বাজেট ৯০ বিলিয়ন ঘোষনার মাধ্যমে তুর্কী রেড ক্রিসেন্টকে ছাড়িয়ে আমরা বিশ্বের সবচেয়ে বড় দাতা সংস্থার অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করছি।
বাঙ্গালি জাতির অর্থনৈতিক উত্থান শুরু বাঙ্গালী অথবা মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখি নি আমরা। আপনাদের যাকাত ও অনুদানের বিপুল অর্থে আমরা দারিদ্র দূরীকরণে কাজ করে চলেছি আফ্রিকার ২০ টি দেশে, আমরা কাজ করছি আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের ক্ষমতায়নে, অস্ট্রেলিয়ার এবরজিনদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে। চীনের উইঘুরদের সামাজিক উন্নয়নে, রাশিয়ার দাগেস্তান ও বাশকিরস্তানে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে।
বন্ধুগন আপনারা ভুলে যাবেন না, আমাদের দেশের সৃষ্টি হয়েছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে। আমরা যেমন আমাদের দেশের ভেতরে ধনী-গরীবের ব্যবধান ঘুচিয়েছি, তেমনি বিশ্বজুড়ে মানুষে মানুষে বৈষম্য দূরীকরনে, শান্তি স্থাপনে কাজ করবে বাংলাদেশ।
পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে, যে কোন মানুষের চাহিদা পূরনে যদি কোন বাংলাদেশী নাগরিক অবদান রাখে, সেটাই হবে আমাদের বিজয়। আমাদের বিজয় আমাদের জন্য, আমাদের বিজয় সবার জন্য।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের ভাষণ শুনছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্টদূত হ্যারি কে টমাস। ভাবছিল, স্বাধীনতার কয়েকশত বছর পরও আমাদের দেশে আন্দোলন হয় ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটারস নামে। রাষ্ট্রদূত হয়েও আমি আমার কালো চামরার জন্য বিব্রতকর বৈষ্যমের শিকার হই যুক্তরাষ্ট্রে। সত্যিই, অনেক কিছু শেখার আছে বাংলাদেশ থেকে। আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশ মানবিক উন্নয়ন সংস্থার প্রধানের সাথে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে দুই দেশের যৌথ মানবিক উন্নয়ন মডেল নিয়ে আলোচনার পরিকল্পনা করছেন মিস্টার টমাস।
এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে সামরিক অস্ত্র প্রদর্শনী। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের নিজস্ব হেলিকপ্টার, ট্যাংক, সাবমেরিন, স্টিলথ যুদ্ধ বিমানের প্রদর্শনী চলছে। সেদিকে কোন ভূক্ষেপ নেই টমাসের। এসব যন্ত্র দরকার রাস্ট্রের। মানুষের দরকার ন্যায় বিচার, সম মর্যাদা, সাম্য। এ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রোল মডেল।
হটাৎ তীব্র ঝাকনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আবদুল্লাহর। বাসের ড্রাইভার কড়া ব্রেক কষেছে। সামনের একটি ভেড়ার পালকে বাচাতে । আংকারা মালভূমি পার হচ্ছে বাস। কাল সকালে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে রাতের বাসে ইস্তাম্বুল শহর থেকে রওনা দিয়েছে আবদুল্লাহ। বক্তব্য দিতে হবে দেশকে নিয়ে, নিজের স্বপ্নগুলো নিয়ে। স্বপ্নের তালিকা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আংকারা মালভূমিতে সূর্য ওঠছে। লাল সূর্য। সম্ভাবনার সূর্য। নতুন দিনের সূর্য। মনে পড়ছে আধো ঘুম আধো জাগরনে তার স্বপ্ন। এটি স্বপ্ন নাকি ইলহাম। স্বপ্ন কি এতো স্পষ্ট হয়? এই স্বপ্ন কি সত্যি হবার মতো?
দেশ নিয়ে আপনার কি স্বপ্ন ?
লেখক : লেকচারার, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক গণমাধ্যম কর্মী।