শময়িতা জাহিদ মিতিন :
গোল একটা কাঁসার প্লেটে ঠিক মাঝে গোল করে সাদা ধবধবে ভাত রাখা। ভাত থেকে বের হওয়া ভাপে কাঁসার প্লেটে শিশিরের মত পানি জমছে। ভাতের উপর রাঙা একটা শুকনা মরিচ রাখা, তেলে ভাঁজা সম্ভবত। সামনেই বাটিতে ঘন ডাল, আর ভাতের সামনে টেনিস বলের সমান আলুভর্তা। একটা মাছি আসতেই পিনি হাত পাখাটা জোরে জোরে এমুখ অমুখ করলো। মাছি উড়তেই ওর সমস্ত মন জুড়ে আবার ছেয়ে গেল ধবধবে সাদা ভাত!
পিনির তাকানো দেখেই হেডমাস্টার কড়মড় করে উঠলেন, 'কিরে বাতাস বন্ধ করলি যে?'
পিনি দিগুণ শক্তিতে আবার পাখা চালানো শুরু করলো।
'ভাত গিলেছিস?'
'উহু।'
হ্যাঁ- না এর একটা মাঝামাঝি উত্তর দিয়ে পিনি জানালার বাইরে তাকাল। দুঃখ, অপমান না ক্ষুধা , কিসের জন্য না বুঝলেও পিনির চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে গেল। ক্ষমতা, সামর্থ্য নাকি তৃপ্তি, কোন একটা কিছুর জন্য হলেও হেডমাস্টারের এতে কোন ভ্রূক্ষেপ হল না।
'যাহ, তোর শাস্তি শেষ।'
পিনি হাত থেকে পাখা নামিয়ে রেখে দিলো ছুট। যদিও ওর বিশেষ কোন তাড়া নেই বাড়ি যাবার। মাতৃহারা সংসারে এবং সৎ মায়ের তদারকিতে পিনি একটা বাহুল্য বা অনাহূত ছাড়া আর কিছু নয়! তাই দুপুরে সবাই যখন যে যার বাসায় চলে যায়, পিনির তখন কিছু করার থাকেনা, শান বাঁধানো একটা গাছের নীচে বসে সে স্কুল থেকে দেয়া বিস্কিটের প্যাকেট টা বের করে, খুব যতœ করে এক মাথা খুলে ওখান থেকে একটা বিস্কিট খায়। আবার মুড়িয়ে কোমরে গুঁজে রাখে।
আজো তাই করছিলো, এমন সময় ওর এক ক্লাস বড় মনির এসে ওর হাত থেকে প্যাকেটটা কেঁড়ে নিলো, নিকৃষ্ট একটা হাঁসি দিয়ে প্যাকেটটা দুমড়ে-মুচড়ে ছুড়ে ফেললো মাটিতে। পিনি করুণ চোখে প্যাকেটটার দিকে তাকাল। তারপর ওর কি যে হল, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মনিরের মুখ বরাবর একটা ঘুষি দিলো। মনিরের ঠোঁট ফেটে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে, মনির ম্যাম্যা করে হেডমাস্টারের রুমের দিকে যাচ্ছিলো।
পিনির হাত পা ঠা-া হয়ে আসলো। দিনের দ্বিতীয় শাস্তি ভয়ানক। আজকের প্রথম শাস্তির কোঁটা ও পূরণ করেছে, দ্বিতীয় শাস্তি মানে হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত বেতের কালচে দাগ। পিনি এক মুহূর্ত-ও দেরী না করে স্কুল থেকে বেড়িয়ে গেল। যত জোরে দৌড়ানো যায়, তত দ্রুত স্কুল ছাড়ল।
হাঁটতে হাঁটতেই ওর আতংকে এতক্ষণ ভুলে থাকা ক্ষুধাটা আবার মোচড় দিয়ে উঠলো। পিনি চোখ বন্ধ করলেই ধবধবে সাদা ভাতের উপর একটা টকটকে লাল মরিচ দেখতে পাচ্ছে! লাল মরিচের উপর একটু হালকা সরিষার তেল, গরম ভাতে মা হাল্কা লবণ মাখিয়ে পিনিকে মুখে তুলে দিলেন, আনন্দে পিনির চোখে আবার জল আসতেই পিনি চোখ খুলে দেখল আকাশ ভর্তি ধবধবে সাদা শরতের মেঘ। বিকেলের রোঁদটা কাঁসার থালার মত ঝকঝক করছে। নীল অংশ টুকুন হল মায়ের আঠা কমে আসা নীল টিপ। একচোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ভিজে আসা পিনির চোখে ভাত, থালা আর মায়ের নীল টিপ, সব একাকার হয়ে গেলো!
লেখক- লেকচারার, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।