মত প্রকাশ

একটি আইকনিক ছবির ভ্রান্তি মোচন

[এতদিন ধরে যে ছবিটিকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের আইকনিক ছবি হিসেবে জানতাম সেটি আসলে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নয়। ছবিটি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ে তোলা]
উন্মুক্ত মাঠে একদল মেয়ে অস্ত্রের ট্রেনিং নিচ্ছে। সারিবদ্ধ মেয়েদের কাঁধে রাইফেল। তাদের সামনে খাকি পোশাকের তিন প্রশিক্ষক। পড়ন্ত দুপুরের লম্বা ছায়া হেলে আছে বিশাল মাঠের সতেজ ঘাসের ওপর। আর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে শুভ্র তুলোর মতো মেঘের মায়া। দূরে বৈদ্যুতিক খুঁটির নিচে অনেক কৌতূহলী চোখ। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে ১২০ ফরম্যাট রোলিকর্ড ক্যামেরায় ছবিটি তুলেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম। ছবিটি দীর্ঘ সময় ধরে বহুল আলোচিত ও মুক্তিযুদ্ধের আইকনিক ছবি হিসেবে বিভিন্ন প্রকাশনায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সরকারি-বেসরকারি কিংবা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও ছবিটিকে ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের আলোকচিত্র হিসেবে প্রদর্শন করছে। ছবিটি ঢাকার আজিমপুর গার্লস হাই স্কুল মাঠে তোলা বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম নানা সময়ে উল্লেখ করে থাকে। কিন্তু দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ছবিটির প্রকৃত ইতিহাস।
সাইদা খানম ১৯৫৬ সাল থেকে আমৃত্যু সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার আলোকচিত্রী হিসেবে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের এই বরেণ্য আলোকচিত্রীকে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তার ছবি দেখা, লেখালেখি পাঠ ও সামগ্রিক কর্ম বোঝাপড়ার চেষ্টা করি। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ‘আমার ব্যর্থতা’ শিরোনামে তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেই প্রবন্ধে তিনি বিজয়ের দিনে কয়েকটি ছবি ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের কোনো আলোকচিত্র ধারণ করতে না পারার বাস্তবতা ও আক্ষেপ তুলে ধরেন। সাইদা খানমের লেখা পড়েই নিশ্চিত হই ছবিটি একাত্তরে তোলা নয়। ছবিটির ব্যাপারে আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাইদা খানমের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী বিশিষ্ট অভিনেত্রী, শিক্ষক ও ক্রীড়া সংগঠক আলেয়া ফেরদৌসীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। সাইদা খানম বেশির ভাগ সময় তাকে নিয়ে ছবি তুলতে বের হতেন। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তারা দুজন সাইদা খানমের বড় ভাই সুরকার আবদুল আহাদের ইস্কাটন গার্ডেনের সরকারি বাসায় ছিলেন। দুজন একই খাটে ঘুমাতেন। সে সময়ে সাইদা খানম আজিমপুর এলাকায় নারীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ছবি তুললে তার জানার কথা ছিল। তবে ১৯৬৫ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে রাইফেল ক্লাবের মেয়েদের যে প্রশিক্ষণ হয় সেখানকার কিছু ছবি তুলেছিলেন সাইদা খানম, যার একটি ওই বছর ২১ নভেম্বর বেগমের প্রচ্ছদে ছাপা হয়। ছবিটির ক্যাপশন ছিল, ‘লক্ষ্য প্রাণের হিম্মত নিয়ে আয় তোরা ছুটে আয়’।
সাইদা খানমের তোলা গ্রুপ ছবিটি যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন সময় ফেসবুকে লেখালেখি করে ইতিহাসের সঠিক তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেন লিনু হক নামের এক লেখিকা। তিনি মূলত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি করেন। ঊনসত্তরের উত্তাল সময়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি ছাত্রলীগের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। একাত্তরে তিনি আজিমপুর অগ্রণী স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়তেন। থাকতেন আজিমপুর সরকারি কলোনির ১৪ নম্বর বিল্ডিংয়ে। এই বিল্ডিংয়ের বিপরীত দিকেই আজিমপুর গার্লস স্কুল। ফলে আজিমপুর গার্লস স্কুলে নারীদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হলে তার না জানার কোনো কারণ নাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আজিমপুর এলাকায় নারীদের কোনো অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হয়নি বলেও তিনি জোরালোভাবে লেখালেখি করেন। তিনি মনে করেন, ছবিটি ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়কার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে তার লেখালেখি আমার নজরে আসে। ফলে আলোকচিত্রের একজন সামান্য সেবক হিসেবে ইতিহাসের ভ্রান্তি মোচনের জন্য আমি ছবিটির প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে ও রহস্য উন্মোচনে অনুসন্ধানে নামি।
কয়েকজন মুক্তিসংগ্রামী নারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, একাত্তরের মার্চ মাসে মেয়েদের মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি হয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের ছাত্রলীগের মেয়েরা সেই সময় ডামি রাইফেল নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। ছাত্র ইউনিয়নের মেয়েদের প্রশিক্ষণ হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে। আর ছাত্রলীগের মেয়েরা প্রথমে কলা ভবনের ছাদে, পরে অপরাজেয় বাংলার সামনের চত্বরে প্রশিক্ষণ নিতেন। সেই প্রশিক্ষণের ছবিগুলো ওই সময় দৈনিক সংবাদসহ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত ছবির মেয়েদের পরিচয় অনেকেরই জানা। কিন্তু সাইদা খানমের তোলা গ্রুপ ছবিটির একজন মেয়ের পরিচয়ও স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ!
১৯৬৫ সালের ২১ নভেম্বর সাপ্তাহিক বেগমের প্রচ্ছদে সাইদা খানমের তোলা রাইফেল কাঁধে যে কিশোরীর ছবি ছাপা হয়, দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তার পরিচয়। আনত চোখের দৃঢ়চেতা এই কিশোরীর নাম মালা খুররম। তিনি প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের কন্যা। মালা খুররম পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সময়ের একটা প্রজন্ম বড় হয়েছে তার গান শুনে। মালা খুররমও সাইদা খানমের তোলা গ্রুপ ছবির কোনো মেয়েকে চিনতে পারলেন না। পরে ছবিটি বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসিমুন আরা হক মিনুকে পাঠাই। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী হিসেবে অস্ত্রের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। ছবি দেখে নাসিমুন আরা হক জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় মেয়েরা অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেবে আর তাদের একজনকেও চেনা যাবে না, এটা তো অকল্পনীয় ব্যাপার।’ ফলে ছবিটি যে একাত্তরের না, তা তিনি নিশ্চিত করেন।
পরে আমি অন্যভাবে ছবিটির রহস্য ভেদের চেষ্টা করি। আমার সংগ্রহে থাকা ১৯৬৫ সালের বেগমের প্রচ্ছদচিত্রগুলো নিয়ে বসি। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বেগমের প্রচ্ছদে অস্ত্র প্রশিক্ষণের ৬টি ছবি ছাপা হয়। ছবিগুলো সাইদা খানম, জহিরুল হক ও আজিজুর রহমানের তোলা। সাইদা খানমের তোলা গ্রুপ ছবিটার সঙ্গে এই দুই আলোকচিত্রীর প্রচ্ছদচিত্র মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে চেষ্টা করি কোনো সামঞ্জস্য পাওয়া যায় কি না। হঠাৎ ১৯৬৫ সালের ৭ নভেম্বর বেগমের প্রচ্ছদে ছাপা হওয়া আজিজুর রহমানের তোলা ছবিটার দিকে চোখ আটকে যায়। খুব কাছ থেকে তোলা একটু নিচু অ্যাঙ্গেলের বলিষ্ঠ ছবিতে রাইফেল হাতে মেয়েটির গলায় পুঁথির মালা। সাদা সালোয়ার-কামিজ পরা ঘন চুলের মেয়েটির ডানদিকে সিঁথি। ঊর্ধ্বাঙ্গে শক্ত করে ভিন্ন রঙের ওড়না বাঁধা। ছবিটার ব্যাকগ্রাউন্ডে শুভ্র আকাশ। আর ক্যাপশনে লেখা ‘দেশ রক্ষার দৃপ্ত শপথ’। সাইদা খানমের গ্রুপ ছবির দ্বিতীয় সারির দ্বিতীয় মেয়েটির সঙ্গে আজিজুর রহমানের ছবির মেয়েটি হুবহু মিলে যায়! ছবি দুটির পার্থক্য শুধু অ্যাঙ্গেলে- একটি কাছ থেকে তোলা, আরেকটি দূর থেকে। তবে ছবি দুটি যে একই সময়ে তোলা ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে মায়াময় মেঘের আলপনাও যেন তার প্রমাণ মেলে ধরে।
ছবিটির বিষয়ে যোগাযোগ করি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের কিছু কিছু ছবি নিয়ে এখনো ভ্রান্তি আছে। ভিন্ন পটভূমির ছবিও ব্যবহৃত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে। এটা যে অসৎ উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে তা নয়, বরং বেশিরভাগ সময়ে এটা হচ্ছে না জানার কারণে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নানাভাবে মহিমান্বিত। ফলে পঁয়ষট্টি বা অন্য পটভূমির ছবিকে আমরা যেন একাত্তরের ছবি হিসেবে বিবেচনা না করি। মুক্তিযুদ্ধের ছবি ব্যবহার ক্ষেত্রে আমাদের খুবই যত্নশীল হওয়া দরকার।
#সাহাদাত পারভেজ
৪ এপ্রিল ২০২৪

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button