মত প্রকাশ

টুয়েলভথ ফেইল এর পিছনের অন্ধকার কাহিনী

রুবাইয়্যাত সাইমুম চৌধুরী :

টুয়েলভথ ফেইল সিনেমাটা সুন্দর । অভিনয় ভালো । তার চেয়েও বড় ব্যাপার এটা সত্য ঘটনা অনুসারে বানানো । আর ভারতের পরীক্ষাটার ব্যাপার আমাদের বিসিএস এর সাথে মিল থাকায় আমাদের দেশের মানুষের রিলেট করতে বেশ সুবিধাও হয়েছে।

গল্পে দেখায় একজন সৎ কেরানী সততার জন্য চাকরী হারায়। তার ছেলে আবার নকলবাজ। কিন্তু একজন সৎ পুলিশের কথা শুনে নকল করা ছেড়ে দিয়ে সৎ পুলিশ হতে চায়। যদিও সততার পুরষ্কার হিসেবে পরের দিনই সেই পুলিশকে বদলি করে দেওয়া হয়।

এর পরের কাহিনী মোটামুটি বাংলা সিনামার মতো । দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ, খেয়ে না খেয়ে, টয়লেট আর বই পরিষ্কার করে , তিনবার পরীক্ষা দিয়ে ফেল করে , শেষ চান্স মানে চারনম্বর বার পরীক্ষা দিয়ে এএসপি ( বাংলাদেশ কনটেক্সে)। এর মাঝে একজন মেয়ে থাকে যে তার সাথে প্রেম করে , কঠিন সময়ে তার সাথে থাকে। শেষে তারা বিয়ে করে সুখে থাকে। শেষ ঘটনা।

সবাই মোটিভেশন নিচ্ছে কঠিন পরিশ্রম করতে হবে , এই নায়িকার মতো ভালো প্রেমিকা জোগাড় করতে হবে – তাহলে জীবন সফল হয়ে যাওয়া যাবে, জীবন যতই আনফেয়ার হোক।

এই সিনেমা বলে যে, জীবন আনফেয়ার হবে, জীবনে অসৎ রাজনীতিবিদ থাকবে যারা নকলের উৎসব করাবে, তোমাকে ঠিক মত ব্যবসা করতে দিবে না। জীবনে অসৎ পুলিশ থাকবে যারা তোমাকে বাধা দিবে। তোমার বাবা কোর্টে যেয়ে বছরের পর বছর পরে থাকবে কিন্তু বিচার পাবে না, তুমি গরীব থাকবা, কষ্ট হবে তোমার , কিন্তু তোমাকে সৎ থাকতে হবে। সব সময় চেষ্টা করতে হবে । খেয়ে না খেয়ে , আটার মিলে ১৬ ঘন্টা কাজ করেও চেষ্টা করতে হবে। তাহলে সফল হবা।

কিন্তু আসলে, সিনেমার পিছনের গল্প হলো তুমি যে সমাজ বা দেশে থাকবা সেটা বদল হবে না। সেটা সবসময়ই খারাপ থাকবে , ৯৯% ক্ষেত্রে সে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবে, অন্যায় করবে , ধনী এবং ক্ষমতাবানদের জন্য সবকিছু ছলে-বলে- কৌশলে বরাদ্দ রাখবে কিন্তু গরীব, ক্ষমতাহীনদের সৎ হবার, পরিশ্রমী হবার, মানবিক হবার শিক্ষা দিবে।

এই সিনেমা মোটিভেশনে বলে না যে, এত কষ্ট করে তোমার সফল হবার সম্ভাবনা ০.১%।

এই সিনেমা মোটিভেশনে বলে না যে , তুমি যে চাকরী পাবার জন্য রক্ত পানি করে চেষ্ট করে যাচ্ছ, সেখানে এখন যারা আছে তাদের বেশীরভাগ সৎ না, সৎ হবেও না।

তাই তুমি শুধু নিজের দারিদ্র থেকে হয়তো এই চাকরীর জন্য মুক্তি পেতে পারো। একটা সুন্দর বৌ জোগাড় করতে পারো , তোমার বিচার না পাওয়া বাবাকে কিছুটা গর্ব করার সুযোগ দিতে পারো -এর বেশী কিছু না। তুমি কিছুই বদল করতে পারবে না। বরং এই সিস্টেম তোমাকে একসময় বদলে দিবে অথবা তুমি এই সিস্টেমের সাথে চলতে না পেরে বিপদে পরে যাবা।

যদি তুমি সফল হওয়া ০.১% এর মানুষের মাঝে না থাকো , তাহলে তোমার জীবন যে অন্ধকারে ছিলো সেখানেই থাকবে । শুধু জীবন থেকে মূল্যবান ৪ টা বছর চলে যাবে । জীবনে এই পরীক্ষা বাদে অন্য কিছু করার সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে তুমি ৪ টা বছর পিছিয়ে যাবে । তোমাকে সফল হবার জন্য ০.১% সুযোগের জন্য যুদ্ধ করতে হবে , যেখানে ১০% মানুষ ৯০% সুযোগ নিয়ে সফল হবে ।

কেনো জানি আমার মনে হয় এসব সিনেমা বানানো হয় মানুষকে বুঝাতে যে, দারিদ্রতা আসলে তোমার সফল হবার জন্য কোনো বাধা না। তুমি সফল না, কারণ তুমি সফল হতে পারো নি। দোষ তোমার।

যথেষ্ঠ চেষ্টা করো নি, যথেষ্ঠ সৎ ছিলে না, একটু কপাল খারাপ দেখে একটা ভালো প্রেমিকা পাওনি। কিন্তু তুমি যে গরীব এটা কোনো সমস্যা না। তোমাকে যে সুযোগ থেকে ইচ্ছে করে বঞ্চিত করা হয়েছে এটা কোনো সমস্যা না। তোমার সাথে অন্যায় করে অন্যায়কারী এবং দূর্নিতীবাজরা যে বিশাল আরাম আয়েশে আছে এটাও কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা তুমি তোমার নিজের কারণে সফল না।

সমস্যা আসলে ব্যার্থ মানুষদেরই। কারণ তারা কখনো গরীব, কখনো তেমন মেধাবী না, কখনো তাদের জন্য সিস্টেম কঠিন, কখনো পুরো রাষ্ট্র, সমাজ তাদের আটকাবার ফন্দি আটে। এর সবই করা হয় নিজেদের স্বার্থে ।

এমন ব্যার্থ দুঃখি মানুষ না থাকলে কারা কামলা হবে? কারা এমন সিনেমার খদ্দের হবে? কারা সস্তা শ্রমের যোগান দেবে? কারা ঘাম দিয়ে বিলাসের কাঁচামাল যোগাবে ?
তাই এই সিনেমা দেখেন , আনন্দ পান, কিছুক্ষণ মোটিভেটেড থাকেন – এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভুলে যাইয়েন না। অন্তত এটা জানুন যে আপনি অন্যায়ের শিকার । চেষ্টা করেন সফল হতে , কিন্তু যদি সফল না হতে পারেন তাহলে নিজেকে দোষ দিয়ে দড়িতে ঝুলে পরিয়েন না। বরং যা, যারা, যেসব আপনার জীবনকে কঠিন করেছে তাদের দোষারোপ করুন, সেসব থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করুন । এটাও সফলতা ।

সবাই সিনেমার নায়কের মতো পরীক্ষায় টিকবে না , প্রেমিকাকে বিয়ে করে সফল হবে না।

কেউ কেউ নিজে ব্যার্থ হয়েও অন্যের জীবন সহজ করতে করতে মারা যাবে । সে সিনেমার সফল হওয়া নায়কের চেয়েও সফল।
কিন্তু আমরা তাকে মনে রাখবো না। মনে রাখবো পরীক্ষা পাশ করা, উর্দি পরা নায়োককে। তারটাই মোটিভেশন।বাকিদেরটা শুধুই অবসারভেশন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button