এমন ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস ছিল না
চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগজুড়ে প্রবল বর্ষণ ও ভয়াবহ বন্যার পূর্বাভাস ছিল না। ১৮ আগস্ট দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে শুধু নদ–নদীর পানি বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল। ভারতের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকেও এমন তথ্য জানানো হয়নি। ফলে হঠাৎ ভয়াবহ বন্যার মুখে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল।
ভারত থেকে বড় ও আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা থাকলে তা বিশেষভাবে জানানোর চর্চা দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের রয়েছে। মুহুরী নদীর উজানে ভারতীয় নদী বিলুনিয়াতে গত তিন দিনে সর্বকালের রেকর্ড–ভাঙা বৃষ্টি হয়েছে। পানির উচ্চতা দ্রুত বেড়েছে; কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কোনো বিশেষ সতর্কবার্তা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।
দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরকার উদয় রায়হান এ বিষয়ে বলেন, ‘গোমতী ও মাতামুহুরী নদীর উজানে ভারতীয় অংশে পানি বৃদ্ধির তথ্য আমরা তাদের ওয়েবসাইট থেকে পাই। তাদের পক্ষ থেকেও আনুষ্ঠানিকভাবে দিনে দুবার তথ্য দেওয়া হয়; কিন্তু এবার বিস্তারিত তথ্য আমাদের জানানো হয়নি। বিস্তারিত তথ্য না পাওয়া গেলে বন্যার বিস্তারিত ও সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।’
বাংলাদেশের উজানে ভারতের তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা অববাহিকায় ভারী বৃষ্টি হলে তা তিন থেকে সাত দিন পরে বাংলাদেশের অংশে অর্থাৎ ভাটিতে আসে। এরপর মৌসুমি বন্যা সৃষ্টি করে; কিন্তু ত্রিপুরায় ভারী বৃষ্টির পাঁচ থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে তা ফেনী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে চলে আসে। এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে ভারতের উচিত ছিল বাংলাদেশকে দ্রুত তথ্য জানানো। এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের বাধ্যবাধকতাসহ চুক্তি হওয়া উচিত।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯ আগস্ট থেকে টানা তিন দিন দেশের পূর্বাঞ্চলে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ৫৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢল এবং পানি নেমে যাওয়ার পথ সংকুচিত হওয়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতি খুব দ্রুত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট মাসে সাধারণত পূর্বাঞ্চলে এত ভারী বৃষ্টি হয় না। বিশেষ করে মাসের শেষের দিকে টানা বৃষ্টি হলেও তা মূলত দেশের উপকূলীয় এলাকা থেকে মধ্যাঞ্চলজুড়ে থাকে। আগস্টে এর আগেও ফেনী ও কুমিল্লায় অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে; কিন্তু তা এক–দুই দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে গত এক মাসে থেমে থেমে অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে। গত মাসের শেষ সপ্তাহে ওই অঞ্চলের বেশির ভাগ জেলায় ১০০ থেকে ২০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও ভারী বৃষ্টি ঝরেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ফেনীর পরশুরামে ২০ আগস্ট ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা গত ৫৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। কুমিল্লায় এবার ২৪ ঘণ্টায় ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১৯৬৮ সালের পর সর্বোচ্চ। ওই বছর এক সময় ২৪ ঘণ্টায় ৪৪২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল। উজানে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া নদীতে এবার ২৪ ঘণ্টায় ১৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। উজান ও ভাটির এই রেকর্ড–ভাঙা বৃষ্টি বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌথ নদী কমিশনের পাঁচটি দায়িত্বের অন্যতম হচ্ছে বন্যার পূর্বাভাস সঠিকভাবে দেওয়া। ভারত ও বাংলাদেশের ৫৪টি যৌথ নদীর পানি ও বন্যার তথ্যবিনিময় সঠিকভাবে করা গেলে এবং বন্যার পূর্বাভাস মানুষের বোধগম্যভাবে উপস্থাপন করা গেলে এত বড় বিপর্যয় হতো না।
পানি নামার পথ সংকুচিত
বন্যার পানি যে পথ দিয়ে নামবে অর্থাৎ বাংলাদেশের গোমতী, ফেনী, খোয়াই, মাতামুহুরীসহ বেশির ভাগ নদ–নদী দুই যুগে ভরাট ও দখল হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের হিসাবে শুধু কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় এ ধরনের দখলদারের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৪৭। চট্টগ্রাম বিভাগ ধরে হিসাব করলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ হাজার। নদী–খাল ও জলাভূমি দখলের কারণে বন্যার পানি নামতে সমস্যা হচ্ছে।
নদী রক্ষা কমিশন থেকে সারা দেশের দখলদারদের একটি তালিকা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হয়। এদের বড় অংশ তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মী ও প্রভাবশালী মহল। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোর মধ্যে কুমিল্লায় প্রায় ৬ হাজার, ফেনীতে ২৭৭, নোয়াখালীতে ৪ হাজার ৩০৩ ও লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ জন দখলদার রয়েছে।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘উজান থেকে আসা পানির ঢল সম্পর্কে ভারতের কাছ থেকে আমাদের সঠিক তথ্য পাওয়া যেমন দরকার, তেমনি ওই ঢল আসার পর তা নামার পথও মুক্ত রাখতে হবে। এ জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত যৌথ নদী কমিশন ও নদী রক্ষা কমিশন। এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রতিষ্ঠাগুলোকে সক্ষম ও কার্যকর করে গড়ে তোলার।
নদী ও পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত সার্বিক বিষয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশের বন্যা ও আবহাওয়া পূর্বাভাস–ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যে ধরনের পূর্বাভাস আমরা যেভাবে দিই, তাতে চলমান বন্যার মতো ভয়াবহ দুর্যোগের বিষয়টি আগাম বোঝা যায় না। আর ভারতের কাছ থেকে আমরা গঙ্গা ও তিস্তার পানিপ্রবাহের তথ্য যত বিস্তারিত পাই। গোমতী ও মুহুরীর মতো অন্য নদীগুলোর ঢল বা পানিপ্রবাহের তথ্য সেভাবে পাই না।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত আরও বলেন, এই বন্যার একটি কারণ হিসেবে ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, পানি বেড়ে গেলে গোমতী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওই স্লুইসগেট স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খুলে যায়। পানি কমলে তা আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়।