প্রত্যাশা-প্রাপ্তির ব্যবধান, আশা-নিরাশায় জনগণ

স্টাফ রিপোর্টারঃ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাস পূর্তি হতে যাচ্ছে আজ। এই ছয় মাসের শাসনামলে নানা চড়াই-উতরাই পার হতে হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন সরকারের। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, দলদাস প্রশাসনকে পুনর্গঠন, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুতে বেগ পেতে হচ্ছে সরকারকে।
ছাত্র-জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ দায়িত্ব পাওয়া এই সরকারের প্রতি বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও ছয় মাসের মাথায় এসে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ব্যবধান দেখা দিয়েছে। মানুষের নিত্য চাহিদা পূরণে সরকারে ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। তবে, সেক্টরভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রকাশ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ, নির্বাচনের টাইমফ্রেম ঘোষণা সরকারকে একটি প্রত্যাশায় জায়গায় নিয়ে গেছে।
ড. ইউনূস সরকারের ছয় মাসের শাসন নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকারের প্রতি এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হলেও এখনো হতাশ হওয়ার মতো কিছু হয়নি। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের উদ্দেশ্যে যে কমিশন গঠন করেছে সেই কমিশনের প্রতিবেদনে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন রয়েছে। তবে সংস্কার কার্যক্রমের বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি সরকার।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকারের ইতিবাচক নানা উদ্যোগ থাকলেও অদক্ষতা ও অসহযোগিতার কারণে কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিই নেই। যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলন আর নানামুখী অসহযোগিতায় সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও তার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ন্যূনতম বোঝাপড়া থাকলেও নির্বাচনি রোড ম্যাপ নিয়ে সরকারের সঙ্গে শীতল দর-কষাকষিতে রয়েছে দলগুলো। এতে নানা ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপে ধীরগতি ও জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।
এদিকে সরকার সংশ্লিষ্টরা বলেন, সরকার গঠনের পর তাদের স্রোতের বিপরীতে পথ চলতে হয়েছে। সামনে এগোনো শুরু করার আগে তাদের ১৫ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে পথ তৈরি করতে হচ্ছে। তারা দাবি করেন, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনসহ সর্বস্তরে যেভাবে আওয়ামী লীগ রাজনীতিকরণ করেছে তাতে এই ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে দেশকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরানো যে কোনো ধরনের সরকারের জন্যই খুবই চ্যালেঞ্জিং কাজ।
সে বিবেচনায় ছয় মাস খুব বেশি সময় নয়। তারা জানান, জনপ্রশাসনে এখনো ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগীরা নানাভাবে সরকারে অসহযোগিতাসহ বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া শুরুর দিকে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল পরবর্তী সময়ে তাদের কেউ কেউ কিছুটা দূরত্ব রক্ষা করে চলছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায় ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের সেক্টরভিত্তিক অভিজ্ঞদের পাশাপাশি ওই সরকারে ছাত্রদের তিন প্রতিনিধি যুক্ত হয়।
দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. ইউনূস সরকার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও সেক্টরভিত্তিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। সংবিধানসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আজ ছয় মাস পূর্তিতে এই ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ ও সমন্বিত প্রতিবেদন জমা দেবে। সংস্কার কমিশন ছাড়াও দেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র জানতে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয়ের নেতৃত্বাধীন গঠিত কমিটি দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। গুম কমিশনও ধারাবাহিকভাবে তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত ঐকমত্য কমিশন শিগগিরই বৈঠক শুরু করবে। দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে যতটা সংস্কার সম্ভব সেটা করেই নির্বাচন দেবে ইউনূস সরকার। সরকার চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের প্রথমার্ধের মধ্যে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে।
সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারকে সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। টানা ২৭ দিনের ছাত্র আন্দোলনের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সুবিধাভোগীদের একটি অংশ আত্মগোপনে চলে যায়। অনেকে দায়িত্বে থাকলেও সরকারকে নানাভাবে অসহযোগিতা শুরু করে। এ ছাড়া শুরুতে দেশের অনেকগুলো থানা পুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করে। পরে অবশ্য তাদের অনেকে থানায় যোগ দেন। এদিকে টানা ১৫ বছরে বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ জনতা শেখ হাসিনা পতনের পরপরই তার দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ভাঙচুর, হামলা করে। এ সময় গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজন হত্যার শিকারসহ মব জাস্টিজের ঘটনা ঘটে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই, ডাকাতি বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চরম অবনতি হয়। এর বাইরে বিগত সরকারের অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের সূত্র ধরে নিত্যপণ্যের মূল্য মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হতে শুরু করে।
এখনো ক্ষমতাধর হাসিনা সরকারের আমলারা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এখনো বহাল শেখ হাসিনার সরকারের আমলারা। ভুয়া ভোট, রাতের ভোট ও ডামি ভোটের কারিগর ডিসি ও এসপিদের অনেকেই এখন প্রশাসনের নীতি-নির্ধারণী পদে আসীন। পতিত সরকারের আনুকূল্য নিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অঢেল সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন, কেউ কেউ এখনো স্বপদে বহাল। এমন অভিযোগ জনপ্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তাসহ প্রশাসন সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসেও জনপ্রশাসন গতিশীল না হওয়ার জন্য প্রশাসন ক্যাডার ও অন্যান্য ক্যাডার দ্বন্দ্বকে দায়ী করছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের মতে, চাকরিবিধি ভেঙে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে যেভাবে সভা-সমাবেশ করা হচ্ছে, তাতে সেবা ব্যাহত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের সুবিধাভোগীরাই এখন দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে বেশি সোচ্চার। প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে শৃঙ্খলা ও গতি ফিরে না আসায় মাঠ প্রশাসনেও বিরাজ করছে স্থবিরতা। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম স্লোগান জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলা এবং ঘুষ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মূলোৎপাটন হলেও প্রশাসনে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা নেই।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
ছয় মাসে অন্তর্বর্তী সরকারকে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়তে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনুপস্থিতি এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড জনমনে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সক্রিয় হওয়ায় সম্প্রতি পরিস্থিতি অনেকাংশে কমে এসেছে। তবে পুলিশের নৈতিক অবস্থা এখনো দুর্বল বলে একটি টকশোকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের আন্দোলন
এদিকে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী সময়ে দেশের নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মাঝে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানা দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। প্রায় প্রতিদিনই সরকারকে কোনো না কোনো মহলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা প্রাঙ্গণে অবস্থান ও ঘেরাও কর্মসূচিও হয়েছে। এ সময় ১৭০টির আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হয়েছে বলে জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তারা আগের সরকারের মতো দমননীতি পরিহার করে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন মোকাবিলা করেছে।
ইউনূস সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত
শেখ হাসিনাবিহীন বাংলাদেশ গত ছয় মাসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা ক্ষেত্রে প্রশংসা অর্জন করেছ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দায়িত্বগ্রহণ দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জাতিসংঘ সম্মেলনসহ চারটি বিদেশ সফরকালে বিশ্ব নেতারা তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুতিকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে কিছুটা শীতল সম্পর্ক তৈরি হলেও বাংলাদেশ তাদের ছাড় দিচ্ছে না। উল্টো দেশের সার্বভৌম ও অধিকার প্রশ্নে ভারত ইস্যুতে শক্ত অবস্থান দেখিয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও ‘অতীতের মতো’ নতজানু নীতি থেকে সরে এসে অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোরালো ভূমিকা দেখিয়েছে। নানা সমালোচনা থাকলেও সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
পতিত সরকারের দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা
এদিকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী নেতাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি করা হচ্ছে। ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মামলা আড়াইশ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা দুই শতাধিক। এখনো নতুন নতুন মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হচ্ছে। এসব মামলায় পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাদেরও আসামি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে একাধিক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
দেশে আত্মগোপনে থাকাদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বিমানমন্ত্রী ফারুক খান, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, কাজী জাফরউল্লাহ, রাশেদ খান মেনন ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুসহ বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছেন। এ ছাড়া সাবেক সরকারের ‘সুবিধাভোগী’ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
দিবস বাতিল-ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার এই ছয় মাসের মধ্যে তার দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার প্রমাণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে তুষ্ট করতে সরকার ঘোষিত নানা দিবস ও স্থাপনার নামকরণে পারিবারিকীকরণ করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার জাতীয় শোক দিবসসহ সেই দিবসগুলো বাতিল করেছে। এসব দিবসের সরকারি ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশেষ নিরাপত্তা দিতে শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের জন্য করা আইন বাতিল করা হয়েছে।
সরকারের ছয় মাসের দেশ পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়ে যে সরকারকে ছাত্র-জনতা দায়িত্ব দিয়েছে তার প্রতি প্রত্যাশা ছিল পাহাড়সমান। সেই জায়গা থেকে অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। সরকার সংস্কারসহ অনেকগুলো ভালো কাজ শুরু করেছে। একটি নতুন ধারা সূচিত হয়েছে। তবে কয়েকটি জায়গায় মানুষের এখনো হতাশা তৈরি হয়েছে। রুটিরুজির প্রশ্নে তারা কেবল হতাশ নয় ক্ষুব্ধও বটে। মানুষ কিন্তু সংস্কারের আগে পেটের ভাত নিশ্চিত চায়। সেটার ওপর আমরা গুরুত্ব কম দেখছি।
তিনি বলেন, আমরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেখছি। কিন্তু সেই তুলনায় বিচারের দিকে নজর কম আছে বলে মনে হচ্ছে। মামলার সংখ্যা বাড়ানোর পরিবর্তে বিচার দ্রুত শেষ করা উচিত।
একের পর এক আন্দোলনের সমালোচনা করে তিনি বলেন, দাবি-দাওয়ার নামে যেসব আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে তা বন্ধ হওয়া উচিত। এ ধরনের ঘটনা দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ব্যক্তিগত এখনো হতাশ নন উল্লেখ করে শিক্ষাবিদ রাশেদ কে চৌধুরী বলেন, অস্বীকার করার উপায় নেই সরকার চেষ্টা করছে। তাদের চেষ্টার ঘাটতি দেখছি না। তবে জনগণের প্রত্যাশার গতিতে সরকার এগোতে পারছে বলে মনে হয় না।
নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সরকার ইতিবাচক এটাই বড় আশার জায়গা বলে মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, চেষ্টার জায়গা থেকে সরকারের ত্রুটি আছে বলে মনে হয় না। হয়তো রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের কিছু দক্ষতার ঘাটতি থাকতে পারে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে যেটা দেখছি তা হলো প্রশাসনের বিভিন্ন কর্নার থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাচ্ছে না। তবে আমি আশাবাদী। তারা এরই মধ্যে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন হাতে পেয়েছে। কমিশনের সুপারিশ পুরোটাই বাস্তবায়ন সরকারের হাতে না থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো সহযোগিতা করছে তারা একটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে।
সরকারের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে একটি টকশোতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিগত সরকারের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, গোটা দেশ একটা ময়লার স্তূপে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয় পাহাড়সম ওই ময়লা সরিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। ছয় মাসের অর্জন প্রশ্নে তিনি বলেন, ছয় মাস কিন্তু একটা দেশের জন্য খুবই কম সময়। তারপরও আমরা বলব যেটা অর্জন করেছি তা অ্যামেজিং।
আমলাতন্ত্রে বড় ধরনের গলদ রয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমলারা ১৫ বছর শেখ হাসিনার লেজুরবৃত্তি করেছে। আমরা হাসিনার লোকদের বাছাই করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। এই জায়গা ঠিক করতে আমাদের ছয় মাস লেগে গেছে। তবে ১৫ বছরে প্রশাসনে যে আবর্জনা তৈরি হয়েছে। এ সময় প্রশাসনকে যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে সরিয়ে এনে কাজ করিয়ে আমরা ভালো ফল পাচ্ছি। ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতি ফেরত আতে শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ আমার দেশকে বলেন, হাসিনার নির্দেশে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর ফলে অভ্যুত্থানের পর নৈতিক মনোবল হারিয়ে পুলিশ কাজে ফিরছিল না। পুলিশকে ন্যূনতম তৎপরতায় ফেরাতে সরকারের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। বাহিনীকে চরমভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের ফলে বহু পুলিশ সদস্য পালিয়ে পর্যন্ত গেছে। সুতরাং সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ সহজ ছিল না। তবে ক্রমেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে।
তিনি বলেন, হাসিনার সময় থেকেই দেশে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিসহ নানা কমিটি গঠনের মাধ্যমে জানতে পারে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যতটা খারাপ ভাবা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে পরিস্থিতি তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ। সেই পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এটা সত্য যে সরকার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষের আকাশচুম্বী প্রত্যাশাকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি, তবে সরকারের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।