অর্থ-বাণিজ্য

ছোট হয়ে আসছে প্রিন্টিং ব্যবসা

স্টাফ রিপোর্টারঃ যুগ যুগ ধরে দাপিয়ে বেড়িয়েছে প্রিন্টিং ব্যবসা। ছাপাখানা ছিল সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে কোনো নথি ছাপিয়ে সংরক্ষণ করা চিরায়ত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। সেখানে বেশ ভাটা পড়েছে। নানা আধুনিক প্রযুক্তি ও অনলাইনের যুগে কদর হারাচ্ছে প্রেস মেশিন। ই-নথির প্রচলন শুরু হওয়ায় প্রিন্ট করার প্রয়োজনীয়তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। ছাপাখানার ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

আধুনিকায়নের সঙ্গে বাড়ছে কালি ও কাগজের দাম। মজুরি না বাড়ালেও শ্রম নিয়োগ কঠিন। কিন্তু ছাপার দরে উন্নতি হচ্ছে না। এ ছাড়া অলিতে-গলিতে অনেক নিম্নমানের প্রেস গড়ে ওঠায় কমে যাচ্ছে মান, অসুস্থ প্রতিযোগিতার কাছে নষ্ট হচ্ছে বাজার।

রাজধানীর কাঁটাবনের স্বস্তি প্রিন্টার্সের মালিক সুজন চন্দ্র দাস বলেন, ‘আগে আমার প্রেসে একজন মেশিনম্যান কাজ করতেন। চাকরি ছাড়ার পর তিনি শ্বশুরবাড়ি থেকে ১০ লাখ টাকা এবং আরও পাঁচ লাখ টাকা ধার করে ‍নিজেই প্রেস কিনেছেন। এমন মেশিনম্যানের সংখ্যাও অনেক। তারা নিজেরাই প্রেস চালায়, আমাদের মতো মালিক নয়, তাই খরচও কম রাখতে পারছে। অথচ আমাকে ২০-২৫ হাজার টাকা মাসে একেকজন শ্রমিককে বেতন দিতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু প্রেস আবার ভ্যাট ও ট্যাক্সের আওতামুক্ত। তাদের খরচ আরও কম। এখন যে অবস্থায় প্রেস ব্যবসা পড়েছে, তাতে ১০-১৫ বছর পর আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে অনেক প্রেসই ঝরে পড়বে। এনজিওর কাজ কমে গেছে, তারা ফান্ড পায় না। মেডিকেলের কাজও কম। আর যারা নিজের টাকায় বই করেন, তারাও বেশি বিক্রি করতে পারেন না। পাঠকের সংখ্যাও কমছে, বইও পিডিএফ হয়ে যাচ্ছে। আর যা লেখা হয়, সেই বইগুলোর সামান্য কিছু বাদে অন্যগুলোর মান একেবারেই নেই। বইমেলার অবস্থাও খুব ভালো নয়। ছেলেমেয়েরা মেলায় গিয়ে ঘোরে, বই দেখে; কিন্তু বাবা-মা টাকা দেয় না বলে কিনতে পারে না। আবার কেউ কেউ দুই হাজার টাকার চাইনিজ খেয়ে ফেসবুকে দেবে, কিন্তু বই কেনার আগ্রহ গড়ে ওঠেনি ।’

একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন নকশা ইমপ্রেশনস লিমিটেডের মালিক রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগের বইমেলায় ২০টি বই করেছিলাম, এবার ৩টি। অন্য সময় হলে এতদিনে ২০-২৫টি বই হয়ে যেত। গতবার নবীন লেখকদের ৫শ’ কপি বই ছাপাতে ৩০-৩২ হাজার টাকা লাগত, এবার একটি ভালো মানের বই করতে ৩৫-৪০ হাজার টাকা লাগছে। টাকার কথা শুনে তারা মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছে। মাসে দেড় লাখ টাকা কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বেতন, ভাড়া সব মিলিয়ে লাগে। ২০০৩ সাল থেকে ছাপার ব্যবসায় আছি। মায়া পড়ে গেছে। তাই ভারসাম্য রেখে চলতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বই ব্যবসার এই দুর্গতির কারণ আমাদের এখানে কালির দাম, কাগজের দাম বেশি। অথচ চীনা কালির দাম কম। আবার লেখকরা বইয়ের রয়ালিটি পান না। বইয়ের মার্কেটিং সিরিয়াসলি কেউ করেন না। অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, বেশিরভাগই খ্যাতির মোহে আবার কেউ বুদ্ধিজীবী হওয়ার লোভে ও লাভে বই লেখেন। উন্নত দেশগুলোতে সরকার বই কিনে নেয়। আমাদের এখানে সেই অবস্থা নেই। লেখক বই লেখেন ক্ষমতাবান হওয়ার জন্য। আর ই-বুকের চাহিদাও দিন, দিন বাড়ছে।’

মেঘনা প্রিন্টার্সের মালিক মিজানুর রহমান খানও হতাশার কথা শোনালেন। তিনি বলেন, ‘বই ছাপিয়ে তেমন একটা লাভ থাকছে না। তবুও এবার গাঙচিল প্রকাশনীর ১৬টি বই চাপিয়েছি। ঘোড়াউতরা প্রকাশনীর কাজও নিয়মিত করি। ডিজাইন, কম্পোজ তারা করে দেয়। প্রিন্টিং আমি করি। এসবের পরও ভালোবাসার টানে বই ব্যবসা ধরে রেখেছি।

তিনি আরো বলেন, ‘এক সময় প্রিন্টিং ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলাম। ধীরে ধীরে নিজেই এখন ব্যবসা পরিচালনা করছি। যদিও প্রেস ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। সবকিছু ডিজিটাল হয়ে গেছে। আগে দোকানদারি করতে ক্যাশ মেমো লাগত। এখন সেগুলোরও প্রয়োজন হয় না। আবার কম্পিউটার চলে এসেছে। আর বই কেনার দিকেও মানুষের আগ্রহ কম।’

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button