পহেলা বৈশাখ উদযাপন : কোথা থেকে এলো মঙ্গল শোভাযাত্রা? কেন এতো বিতর্ক?

আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ : বাংলা নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনুসন্ধানে তথ্য মেলে, মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রচলন বেশিদিন হয়নি। গেল দুই দশকের মধ্যে ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা তথাকথিত এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আমদানি করেন। আবহমানকাল থেকে এ দেশে বাংলা নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখ যেভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। সে ঐতিহ্যকে ম্লান করতেই আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটানো হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা।
মহান জুলাই বিপ্লবের পর সবার প্রত্যাশা ছিল নতুন বাংলাদেশের প্রথম পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা হবে নিজেদের ঐতিহ্য ধারণ করে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ প্রতিফলিত হবে বৈশাখের আয়োজন-উদযাপনে। কিন্তু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হতাশ করেছে। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
গেল ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা শেষে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন হচ্ছে না। একই সঙ্গে তিনি জানান, এবারকার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান দুই দিনব্যাপী উদযাপন করা হবে ।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের জীবনযাপন, উৎসব আয়োজন ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে মঙ্গল শব্দের ব্যবহার নেই বললেই চলে। আবহমান বাংলার হাজার বছরের মূলধারার সংস্কৃতিতেও মঙ্গল শব্দের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য নয়। কিন্তু ১৯৯৬ সাল থেকে নববর্ষের এ শোভাযাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামকরণ করা হয়। আগে এটি আনন্দ শোভাযাত্রা ও বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা নামে পালন করা হতো। শোভাযাত্রার প্রচলনও শুরু হয় মাত্র ৪০ বছর আগে, ১৯৮৬ সালে যশোরে।
তারা আরো জানান, মঙ্গল শোভাযাত্রায় ময়ূর, পেঁচা, কুমির, হাতি, ঘোড়া, বাঘসহ যেসব মুখোশ ও প্রাণিমূর্তি প্রদর্শন করা হয়, তা কখনো বাংলাদেশের সর্বজনীন সংস্কৃতির উপাদান ছিল না। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠী হাজার বছর ধরে মূর্তি সংস্কৃতি ও প্রাণী পূজার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মানবীয় মূল্যবোধসমৃদ্ধ একটি শক্তিশালী বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ধারা সৃষ্টি করেছে, যার প্রতিফলন মঙ্গল শোভাযাত্রায় পাওয়া যায় না। এমনকি মঙ্গল শোভাযাত্রায় কৃষির উপাদানগুলোও যথেষ্ট গুরুত্ব পায় না।
বলা হয়ে থাকে, মঙ্গল শব্দের মধ্যে মঙ্গলের বার্তা আছে। মানুষ, সমাজ ও দেশের মঙ্গল কামনায় যে মঙ্গলযাত্রা, সেটাই এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। সব অশুভকে পরাজিত করে মঙ্গলময় হওয়ার প্রত্যাশা থাকে এ শব্দে।
বাস্তবতা হচ্ছে, হিন্দু গ্রন্থমতে মঙ্গল ভূদেবী ও বরাহদেবের পুত্র। তিনি মঙ্গল দোষের প্রভু বা আগ্রাসনের দেবতা। মঙ্গল দেবতার রঙ রক্তবর্ণ বা অগ্নবর্ণ। এজন্য মঙ্গল শোভাযাত্রায় রক্ত ও আগুন রঙের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
মূলত মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণা এসেছে হিন্দু ধর্ম ও কলকাতার সংস্কৃতির অংশ মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল কাব্য, মঙ্গল ঘট ও মঙ্গল গীতের ভাব ও বৈশিষ্ট্য থেকে। অথচ সম্রাট আকবর এ অঞ্চলের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার কথা চিন্তা করে হিজরি সনের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলা সনের সূচনা করেছিলেন। মোগল রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ আমীর ফতহুল্লাহ সিরাজী ছিলেন বাংলা সনের আবিষ্কারক। বাংলা সন তাই একান্তভাবে এ অঞ্চলের মুসলিম সভ্যতার অংশ । কিন্তু বাংলা নববর্ষ উদযাপনে বাংলাদেশের মূলধারার সংস্কৃতি উপেক্ষা করে কলকাতার সংস্কৃতির প্রচার এবং মঙ্গল শব্দের মতো নির্দিষ্ট ধর্মীয় শব্দ দিয়ে নামকরণ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বহু আগে থেকেই বাংলাদেশে বিতর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল বাংলাদেশি এক আইনজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আদালতের মাধ্যমে আইনি নোটিস পাঠিয়েছিলেন। সে সময় তিনি দাবি করেন, ‘মঙ্গল’ শব্দটি একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় শব্দ। এ শোভাযাত্রায় বৃহদাকৃতির পাখি, মাছ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অপচেষ্টা করা হয়।
বিজ্ঞজনরা মনে করেন, দেশের আপামর মানুষের চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল রেখে পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম পরিবর্তন করে ‘নববর্ষের শোভাযাত্রা’, ‘বৈশাখী শোভাযাত্রা’, ‘নতুন দিনের শোভাযাত্রা’, ‘শুভযাত্রা’ ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে।