আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে দেশ চালাচ্ছে সরকার: বিসিআই
অর্থনৈতিক রিপোর্টারঃ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতিতে কোনো নজর নেই। বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে অর্থনীতি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না, এটা পরিষ্কার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেশ চালানোর চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধূরী। তিনি বলেন,আমরা দেখতে পাচ্ছি যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন নিয়ে দেশ চালানোর চেষ্টা করছে। তবে বর্তমানে দেশের যে অবস্থা সেখানে এই প্রেসক্রিপশন কাজে দেবে না।
বিসিআই সভাপতি অভিযোগ তুলে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক নীতি নিয়েছে; তারল্য সরবরাহ কমিয়েছে-এ ধরনের নানা উদ্যোগ আছে। এগুলো দেশের অর্থনীতির জন্য, শিল্পের জন্য, ব্যবসায়ীদের জন্য অনুকূল নয়। আমরা আইএমএফের প্রেসক্রিপশন নিয়ে কিছু জায়গায় প্রস্তুতি নিতে পারি; কমপ্লায়েন্স পূরণ করার জন্য অনেক জায়গায় কাজ করতে পারি। কিন্তু আইএমএফের প্রেসক্রিপশন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে গেলে সেটি আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
শনিবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শিল্প ও ব্যবসা–বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বিসিআই।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিসিআইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি প্রীতি চক্রবর্তী, পরিচালক শহিদুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন, এস এম শাহ আলম, জিয়া হায়দার, জাহাঙ্গীর আলম, রেহানা রহমান, শাহ আলম লিটু, নাজমুল আনোয়ার ও খায়ের মিয়া।
আনোয়ার-উল আলম বলেন, সরকার একদিকে সুদ হার বাড়িয়ে রেখেছে, পাশাপাশি রয়েছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত জ্বালানি সমস্যার সুরাহা হয়নি, বরং নতুন করে দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথা হচ্ছে। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করে দেয় যে সরকারের কার্যক্রম শিল্প খাতের জন্য ইতিবাচক নয়। এভাবে চললে নতুন শিল্প দূরের কথা, বিদ্যমান শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোও অর্থনীতি নিয়ে চিন্তিত নয় বলে জানান বিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোও অর্থনীতি নিয়ে চিন্তিত নয়। তারা একে অপরকে নিয়ে নানা কথা বললেও অর্থনীতি নিয়ে কিছু বলছে না।
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আনোয়ার-উল আলম বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ভয় কে পাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধানও কেউ দেখছে না। তবে আমরা মনে করি অন্তর্বর্তী সরকারের যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় চলে যাওয়া উচিত। তাতে সবার মাঝে স্বস্তি আসবে।
গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া কখনো স্বস্তি আসবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এটি বুঝে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সংস্কার করে এবং বাকি সংস্কারের জন্য একটি পথনকশা করে দিতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের অর্থনীতি নিয়ে কোন আগ্রহ নেই।
সরকারের কর্তাদের বক্তব্য বিভ্রান্তিমূলক
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়লেও ব্যবসায়ীদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আর অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভ্যাট যা বাড়ানো হয়েছে, তাতে জিনিসপত্রের দাম তেমন একটা বাড়েনি। সরকারের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের এমন বক্তব্যকে বিভ্রান্তিমূলক বলে মন্তব্য করেছেন বিসিআই সভাপতি।
আনোয়ার-উল আলম বলেন, সরকারের এমন বক্তব্যগুলো বিভ্রান্তিমূলক। সরকারের ব্যয় সংকোচনের জায়গায় আমরা কিছু দেখছি না, রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তাদের করজাল না বাড়িয়ে সহজ উপায়ে (ভ্যাট বৃদ্ধি) গেছে। আবার বলা হচ্ছে ভ্যাট বৃদ্ধি দামের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এই বিষয়গুলো শিল্প উদ্যোক্তাদের দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলছে।
দুই-চার জন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা ব্যাংক লুট করেছে, তাদের দায় সবার ওপর চাপানো হলে সেটি অবিচার হবে বলে মনে করেন বিসিআই সভাপতি। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা বর্তমানে হতাশায় ভুগছে। ব্যবসায়ীরা চায় ইজ্জত-সম্মান নিয়ে চলতে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে খেলাপি বলা হয়; কেন খেলাপি হলো সেটি দেখা হয় না। বিগত সময়ে বিভিন্ন কারণে যে পরিমাণে ব্যবসায়িক খরচ বেড়েছে সেটি সবার পক্ষে সামলানো সম্ভব হয়নি। এ কারণে অনেকে খেলাপি হয়েছেন। এজন্য কি সেই উদ্যোক্তারা দায়ী?
আনোয়ার-উল আলম বলেন, খেলাপি নিয়ে সরকারের যেমন নীতি আছে, প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বও সরকারের রয়েছে। আর সুরক্ষা দিতে না পারলে উদ্যোক্তাকে ব্যবসা থেকে বিদায় নিতে হবে। কিন্তু এ সম্পর্কিত কোন দেউলিয়া আইন দেশে নেই। এটি নিয়ে সম্প্রতি গভর্নরের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি নীতিগতভাবে এ বিষয়ে সম্মত হয়েছেন।
গ্রাজুয়েশন তিন বছর পেছানোর দাবি
আগামী ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তীর্ণ হওয়ার কথা রয়েছে। তবে এই সময়কে আরও তিন বছরের জন্য অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত পেছানোর দাবি জানিয়েছে বিসিআই। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি বলেন, গত (আওয়ামী লীগ) সরকার বাহবা নেওয়ার জন্য স্ফীত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দিয়ে গ্রাজুয়েশনের পথে হেঁটেছিল। আমরা মনে করি গ্রাজুয়েশনের সময় না পেছালে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ধস নামবে। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি গ্রাজুয়েশনের সময় কমপক্ষে তিন বছর পেছানো প্রয়োজন।
আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী বলেন, যেখানে তিন বেলা ভাত খাওয়া সক্ষমতা নেই, সেখানে মোরগ-পোলাও খাওয়ার চিন্তা কিভাবে করি। আমরা মনে করি, এলডিসি উত্তরণের জন্য আমরা প্রস্তুত নই। আর প্রস্তুতি না থাকলে আমরা জেনেশুনে কেন আত্মহত্যা করব?