রাজশাহীতে ৩৪ কোটি টাকার শিশু হাসপাতাল অলস
জেলা প্রতিনিধি,রাজশাহীঃ উদ্বোধনের প্রায় দুই বছর হতে চললেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখনও চালু হয়নি ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত রাজশাহী শিশু হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। গণপূর্ত বিভাগের কাছ থেকে এর দায়িত্ব কে নেবে তা নিয়ে দেখা দিয়েছে জটিলতা। সংকট নিরসনে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চান সংশ্লিষ্টরা।
রাজশাহী সিভিল সার্জনের ভাষ্য, ‘গণপূর্ত বিভাগের পক্ষ থেকে আমাদের এখনও চিঠি দিয়ে জানানো হয়নি।’ ফলে দাপ্তরিক এমন চিঠি চালাচালিতে পড়ে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ অঞ্চলের শিশুরা। ২০০ শয্যার এ হাসপাতালটি খালি পড়ে থাকলেও ২০ জেলার শিশু রোগী সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতালটি নির্মাণে ১৩ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও সাত বছর ধরে কয়েক দফায় তা বাড়িয়ে হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ২০০ শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।
এরপর ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন। এরপর পার হয়েছে দুই বছর। তারপরও হাসপাতালটির কার্যক্রম চালু না হওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি চালু করতে জনবল এবং মেডিকেল সামগ্রীও দরকার। সেটি এখনও পাওয়া যায়নি। এজন্য হাসপাতালটি চালু করা যাচ্ছে না।
নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, হাসপাতালটি কোন দপ্তরের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে, সে নির্দেশনা এখনও পাওয়া যায়নি। ফলে হাসপাতালটি পড়ে আছে দিনের পর দিন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, নবনির্মিত হাসপাতালের জায়গায় আগে সরকারি কোয়ার্টার ছিল। সেগুলো ভেঙে পূর্ণাঙ্গ শিশু হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী হাসপাতাল নির্মাণ শুরু করে গণপূর্ত বিভাগ। এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালের মে মাসে ভবন নির্মাণকাজের শুরুতেই জটিলতায় পড়ে নকশা নিয়ে। প্রথমে ১০ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা নেমে আসে চার তলায়। যে ১০ তলা ভবনটি করার পরিকল্পনা ছিল ১৬ হাজার বর্গফুটের, পরে সেই নকশা সংশোধন হলে ২৭ হাজার বর্গফুট সীমানায় চারতলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। শিডিউল মতে, ২০১৮ সালের জুন মাসে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এরপর আরেক দফা বাড়িয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
হাসপাতালটির প্রথম তলার আয়তন ১৯ হাজার বর্গফুট। এখানে রয়েছে ১৪ শয্যার জেনারেল অবজারভেশন ইউনিট। এক্স-রে করানোর জন্য দুটি এবং সিটি স্ক্যান ও এমআরআইর জন্য একটি করে কক্ষ রাখা হয়েছে। স্টোর হিসেবে রয়েছে ৮টি কক্ষ। নিচতলায় একসঙ্গে ২০টি গাড়ি পার্কিংয়েরও ব্যবস্থা রয়েছে। ২০ হাজার ২২৫ বর্গফুটের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি মাইনর অপারেশন থিয়েটার (ওটি) এবং চারটি বিশেষায়িত ওটি।
এ ছাড়া ১০ শয্যার প্রি ও পোস্ট অপারেশন থিয়েটার এবং ৫৬ শয্যার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ইউনিট করা হয়েছে। চতুর্থ তলায় রয়েছে শিশুদের ৯৬ শয্যার সাধারণ ওয়ার্ড এবং ১৮ শয্যার পেয়িং শয্যা। হাসপাতালে রোগী ভর্তি রাখার পাশাপাশি বহির্বিভাগেও চিকিৎসা দেওয়া হবে। তৃতীয় তলায় চিকিৎসকদের জন্য করা হয়েছে ১৮টি কক্ষ। হাসপাতালে থাকবে ক্যান্টিন, ল্যাব এবং অফিস ব্লক।
এই হাসপাতাল নির্মাণকাজের তদারকির দায়িত্বে থাকা রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-২ এর সুত্রে জানা গেছে, নির্মাণকাজ প্রায় দুই বছর আগে শেষ হয়েছে। প্রথম দফার করা রঙ উঠে যাওয়ায় এক মাস আগে আবার রঙ করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল কেউ বুঝে নিচ্ছে না।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, আমাদের হাসপাতালের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ২০০ জন। এখানে আমাদের ৮০০ থেকে এক হাজার শিশুকে প্রতিদিন সেবা দিতে হচ্ছে। এক বিছানায় ৪-৫ জন পর্যন্ত রোগী রাখতে হয়। এতে করে রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, শিশুদের বিষয়টি এমনিই স্পর্শকাতর। তারপরও তাদের এখানে এভাবে রাখতে হয়। নতুন হাসপাতালটি হলে আমাদের জন্য চিকিৎসা দেওয়া ও রোগীদের সেবা গ্রহণে সুবিধা হবে।
রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কর্মকর্তারা জানান, বিষয়টি আমরা অবহিত আছি। এটি নিয়ে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি চালাতে গেলে জনবল, অর্থসহ আনুষঙ্গিক বিষয় রয়েছে। এর জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে সমন্বয় করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমরাও চাই বিষয়টি দ্রুত সুরাহা হোক।
রাজশাহীর সচেতন মহল মনে করেন জনবান্ধব এ ধরনের প্রকল্পটি চালু না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবরূপ না পাওয়ার পেছনে কারও হাত আছে কি না সেটিও খতিয়ে দেখা উচিত। শিশুদের ভবিষ্যৎ, তাদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ ধরনের একটি প্রকল্প বিলম্বিত হওয়া কাম্য নয়।