জাতীয়

কোরআনের প্রথম আদেশ ‘পড়ো’

মুক্তমন ডেক্সঃ ইসলামের প্রধান ভিত্তি মহান আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ করা মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। পৃথিবীর নির্ভুলতম বই আল-কোরআন। কোরআনের দ্বিতীয় প্রারম্ভিক সুরা আল-বাকারার শুরুতে এ বই সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই পরিচয় দিয়েছেন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহ।’ ‘এটি এমন কিতাব বা বই যাতে সন্দেহের অবকাশ নেই’। (সুরা বাকারা : ২) তাই কোরআনের উম্মত বস্তুত কিতাবের উম্মত। কোরআনের জাতি বইয়ের জাতি। পাঠ ও জ্ঞানের জাতি। আরবিতে বলা হয় : নাহনু উম্মাতুল কিরাআহ। অর্থাৎ,আমরা পড়ার জাতি। আমরা পাঠনিমগ্ন উম্মত।

এমনকি আল্লাহর প্রথম প্রত্যাদেশ : ‘পড়ো’। দীর্ঘ তেইশ বছরে নাজিল হয় শেষ নবীর ওপর আল্লাহর সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ। মানবতার সবশেষ মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এই পবিত্র কিতাবের প্রতিটি লাইন প্রতিটি হরফে গাঁথা আছে মানুষের ইহ ও পরকালীন কল্যাণের বিচিত্র উপাদান। সেই গ্রন্থের প্রথম যে আদেশ প্রেরণ করা হয় সাত আসমানের ওপর থেকে, সেটা পড়াসংক্রান্ত নির্দেশনা : ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক : ১-২)

এই একটি তথ্যই যথেষ্ট ছিল মুসলিম উম্মাহকে পাঠমুখী জাতি বানাতে। অথচ আল্লাহ তার সম্মানিত কিতাবে এতটুকুতে সীমিত থাকেননি। নানাভাবে তিনি মানুষকে পড়তে-শিখতে এবং জ্ঞান অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার বার্তাবাহক আমাদের প্রিয়তম নবী (সা.) ও অনেকবার অনেক বাণীতে পড়তে তথা জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

নবীজি (সা.) যে সময় ও সমাজে প্রেরিত হন, তাকে বলা হয় আইয়ামে জাহিলিয়া। অজ্ঞতা ও মূর্খতার যুগ। এ সমাজের জন্য আল্লাহর প্রথম আদেশ নামাজ বা রোজার নয়, পড়ার। জ্ঞানের আলোয় নিজের ক্ষুদ্রতা আর স্রষ্টার বিশালতার পরিচয় লাভ করার। এই জাহিল মুশরিকদের বিরুদ্ধে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ গাজওয়ায়ে বদরে বিজয়ী হয় কোরআনের জাতি। মুসলমানদের হাতে বন্দি হয় পৌত্তলিক বাহিনীর কিছু সদস্য। এদের মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় সাহাবিদের পরামর্শসভায়। যেসব বন্দির মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের সম্পর্কে নবীজি (সা.) ফয়সালা দেনÑযারা লেখাপড়া জানে, তারা আমাদের ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা শেখাবে। এটাই তাদের মুক্তিপণ!

এ তথ্য আমাদের সামনে কী বার্তা দেয়? এটাও আমাদের সামনে পড়া এবং সাক্ষরতার গুরুত্ব তুলে ধরে। কিন্তু পরিতাপ, পড়ার এ জাতি আজ পড়তে ভুলে গেছে। কোনো মুসলিম দেশেই শিক্ষিতের হার শতভাগ নয়। বিশ্ব আজ অধ্যয়ন ও গবেষণায় যে চূড়াছোঁয়া উচ্চতায় উপনীত, আমাদের অবস্থান তা থেকে অনেক নিচে। সাধারণ পড়া আর জ্ঞানার্জনের কথা বাদই দিলাম, ধর্মীয় যে জ্ঞানটুকু মুসলিম হিসেবে আহরণ জরুরি, তাতেও অবস্থা সন্তোষজনক নয়, কারো কারো ক্ষেত্রে তো হতাশাজনকও।

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে মানুষের বিনোদন তথা দেহের খোরাকের সঙ্গে মনের খোরাক বেড়েছে বিকল্পধারায়। কিন্তু আদি ও আসল ধারায়, পাঠ ও অধ্যয়নের ঈপ্সিত উপায়ে বিনোদনসন্ধানীর সংখ্যা শুধু কমেই চলেছে। ভাবতে কষ্ট লাগে, যাদের আবিষ্কৃত আধুনিক উপকরণ আমাদের বই থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে, তারা ঠিকই পড়ছে, জ্ঞানরাজ্যে সাঁতরাচ্ছে, অথচ আমরা ক্রমেই আরো পাঠবিমুখ হচ্ছি।

বলবেন, না পড়লে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে কীভাবে? বলব, হ্যাঁ আমরা পড়ি। কিন্তু সেটা চাকরির পড়া, পেশাগত পাঠ। ডাক্তার পড়েন ডাক্তারি বই, উকিল ওকালতির, রাজনীতিকরা রাজনীতির। কিন্তু নিজেকে অবিরত ভাঙা-গড়া, আরো আলোকিত ও দীপান্বিত করার, ঋদ্ধ ও সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ার সেই সর্বভুক, সর্বপ্লাবী পাঠ কই? মনুষ্যত্ব অর্জন ও মানবিকতা বিকাশের সেই আলোর অনুসন্ধান কই?

পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা কম নয়। ২০০ কোটির ওপর মুসলমানের বসবাস বর্তমানে। ৫০টির ওপর মুসলিম দেশ রয়েছে। কিন্তু আর কোনো জাতি কি আছে এত নিঃস্ব কিংবা অধিকারহারা? পৃথিবীতে সবচেয়ে নিগৃত অঞ্চলগুলোর তালিকা দেখুন, সেটা মুসলিম জনপদ। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি রোহিঙ্গা। এরা মুসলিম। দুঃখজনক হলেও সত্য, পৃথিবীতে এখন যে দেশগুলোয় গৃহযুদ্ধ চলছে, তার অধিকাংশই মুসলিম দেশ। সাম্প্রতিককালে পৃথিবীতে শরণার্থীর যে বিশাল ঢেউ ইউরোপসহ বিশ্বের নানা দেশে আছড়ে পড়ছে, তার সিংহভাগও আসছে মুসলিম দেশগুলো থেকে। সন্দেহ নেই এসবের অনেক জাগতিক ও নৈতিক কারণ রয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা সেসবের পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঠ তথা জ্ঞানবিমুখতা অনেকাংশে দায়ী।

সঠিক জ্ঞান না থাকলে যেমন নিজের ভালো বোঝা যায় না, মন্দও প্রতিরোধ করা যায় না। যেমন প্রাপ্য অধিকার অর্জন করা যায় না, তেমনি হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারও করা যায় না। তাই নিজেদের গড়া ও অধিকার বুঝে পাওয়ার জন্য জ্ঞানের শক্তিতে সমৃদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। এ ছাড়া আমাদের ভাগ্যবদল সুদূর পরাহত। আমাদের পড়তে হবে সব সময়, সব বয়সে। এটাই যেন আমাদের উদ্দেশে সাত আসমানের ওপর থেকে পাঠানো আল্লাহর প্রথম বার্তা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button