গুলিবিদ্ধ ওয়াসিমের মৃত্যু নিশ্চিতে ছুরিকাঘাত
চট্টগ্রাম প্রতিনিধঃ চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলশহর স্টেশনে ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে মাঠে থাকা আন্দোলনকারীদের সমাবেশস্থল। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই শিক্ষার্থীদের সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল সেখানে। এ কারণে আগে থেকেই সেখানে অবস্থান নেয় যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর বাবর ও নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা।
অবস্থা বুঝে ছাত্ররা তাদের সমাবেশ সরিয়ে নেয় মুরাদপুরে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। একসময় ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা একযোগে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। ওই গুলিতে আহত হয়ে পড়ে যান ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম। গুলিবিদ্ধ সেই ওয়াসিমকে আহত পেয়ে তারা কাছে এসে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পরে কয়েকজন সহযোদ্ধা তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
সারা দেশের ছাত্র-জনতা যখন রাস্তায় নেমে এসেছিল, সে সময় ওয়াসিম আকরাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে আমার প্রাণের সংগঠন। আমি এই পরিচয়ে শহীদ হব।’ ওই স্ট্যাটাসের ১৬ ঘণ্টার মধ্যেই সত্যি সত্যিই শহীদ হয়ে যান ওয়াসিম। আর তিনিই মর্যাদা পান জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদের।
সেই সন্তানকে হারিয়ে এখনও চোখের পানি ফেলছেন ওয়াসিমের বাবা-মা। প্রবাসফেরত বাবা শফিউল আলম ছেলের কথা মনে হলেই ক্ষণে ক্ষণে ছুটে যান কবরে। আর আদরের ছেলেকে এখনো খুঁজে বেড়ান মা।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাই, তিন বোনের মধ্যে ওয়াসিম ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা সৌদিপ্রবাসী শফিউল আলম ও মা জ্যোৎস্না বেগম। বড় ভাই মহিউদ্দিন একসময় বিদেশে থাকলেও বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান করছেন। ছোট আরও দুই বোন পড়াশোনা করেন।
ওয়াসিম ২০১৭ সালে পেকুয়া সদর ইউনিয়নের মেহেরনামা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১৯ সালে বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হন। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন। চকবাজার এলাকায় একটি মেসে থাকতেন তিনি।
কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় উপজেলা পেকুয়ার মেহেরনামা এলাকার সন্তান ওয়াসিম আকরাম। স্বপ্ন দেখতেন বিদেশে উচ্চশিক্ষার। তবে রাজপথে শহীদ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হলেও অপূর্ণ রয়ে গেছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন।
বাবা শফিউল আলম বলেন, ‘ওয়াসিম আমার ছেলে, এটা আমার জন্য গর্বের। ছেলের স্বপ্ন ছিল ইউরোপ যাবে উচ্চশিক্ষা নিতে। তার আগে দেশের জন্য সে প্রাণ দিয়েছে।’ তিনি আরও বেলেন, ‘জুলাই বিপ্লবে দেখেছি কীভাবে ছোট ছোট বাচ্চাদের পাখির মতো করে গুলি করে খুন করা হয়েছে। ওরাও আমার সন্তান। দেখেছি রক্তাক্ত লাশ রাস্তায় পড়ে থাকতে। আমি শুধু ওয়াসিমেরই নয়, বরং সব হত্যার বিচার চাই।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চট্টগ্রাম কলেজের সমন্বয়ক ইবনে হোসাইন বলেন, সারা দেশের দ্বিতীয় ও চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিম আকরাম। তিনি ২৪-এর তারুণ্যের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে চট্টগ্রাম কলেজে একটি ভবন, ছাত্রাবাস কিংবা কোনো চত্বর নির্মাণের জন্য প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি আমরা।
পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক এম ফরহাদ হোছাইন বলেন, ওয়াসিমকে ছাত্ররাজনীতিতে আনি আমি। পরে তাকে পেকুয়া সদর পূর্ব জোন ছাত্রদলের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক, এরপর একই ওয়ার্ডের সভাপতি ও সর্বশেষ পেকুয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য করি।
তিনি বলেন, শুরু থেকেই ওয়াসিম ছিল জিয়ার আদর্শের অদম্য সৈনিক। দলের দুঃসময়ে ও জাতির ক্রান্তিকালে যখন ছাত্রনেতারা রাজপথে আসার সাহস পেত না, তখন বেশ কজন ছাত্রনেতার মধ্যে ওয়াসিম আকরাম বিভিন্ন দাবি আদায়ে ও স্বৈরাচার পতন আন্দোলনের মিছিলের সম্মুখসারিতে থাকতেন।