মত প্রকাশ

রেফারেন্সমুক্ত দুনিয়া গড়ার ফর্মুলা চাই

কাজী মুস্তাফিজ

ঘটনা ১:
বছর দশেক আগে আমার একজন প্রবাসী আত্মীয় তার জীবনবৃত্তান্ত তৈরিতে আমার সহযোগিতা চাইলেন। তিনি দুবাইতে পাঁচ তারকা রেস্তারাঁয় চাকরি করতেন। তার কর্মস্থলের অভিজ্ঞতা এবং নাম-ঠিকানাসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে জীবনবৃত্তান্ত প্রায় তৈরি। শেষের দিকে এসে ‘রেফারেন্স’ হিসেবে কার নাম-ঠিকানা দেবেন জানতে চাইলাম। এতে তিনি কিছুটা অবাক হলেন।
জানতে চাইলেন রেফারেন্স কি দিতেই হয়? বললাম হ্যাঁ, ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হলে রেফারেন্সের ব্যক্তির সঙ্গে চাকরিদাতা যেন যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া চাকরিপ্রার্থী ব্যক্তি হিসেবে কেমন তা কোনো না কোনো মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে তারপর চাকরি দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। শেষমেষ তিনি কার যেন রেফারেন্স উল্লেখ করেছেন তা মনে নেই। এই ভদ্রলোক দীর্ঘ দিন দুবাইয়ের মতো জায়গায় পাঁচ তারকা রেস্তোরাঁয় চাকরি করেছেন অথচ রেফারেন্স কী জিনিস বুঝেন না!
ঘটনা ২:
সম্ভবত ২০১০ সালের ঘটনা। মফস্বল থেকে আমার ঢাকায় আসার বয়স প্রায় দুই বছর। যে প্রতিষ্ঠানে ঢাকায় প্রথম কর্মজীবন শুরু করেছি সেখানকার সময় পুরিয়ে এসেছে। অন্য কোথাও আরেকটু ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে চাকরি বদলানোর চিন্তা। কাকরাইলে অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালেয়ের একটি ক্যাম্পাস ছিল। সেই ক্যাম্পাসে একজন কম্পিউটার অপারেটর নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেখলাম রাস্তার পাশে দেওয়ালে। যোগাযোগ করে ব্যবহারিক পরীক্ষা দিলাম। ভদ্রলোক আমাকে বেশ কিছু কাজ দিলেন মাইক্রাসফট ওয়ার্ডে। সন্তুষ্ট হলেন আমার কাজে। একটা স্লিপে পরীক্ষার ফলাফল হিসেবে কী যেন লিখে আরেকজনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন একজনের কাছে পাঠালেন।
সেই ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি আমার জীবনবৃত্তান্ত, ব্যবহারিক পরীক্ষার ফলাফল দেখার পর জানতে চাইলেন আমার ঢাকায় কে আছে তার নাম-ঠিকানা লাগবে। পরে জানালাম, আপনাদের ওই কক্ষে একজন মুরুব্বিকে দেখলাম, ওনার বাড়ি বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুরে। আমার বাড়ি ফেনীতে। ঢাকায় আঞ্চলিক একটা অনুষ্ঠানে ওনাকে দেখেছি, সেই হিসেবে ওনাকে চিনি। শেষমেষ বেতনের অংকে বনিবনা না হওয়ায় সেই চাকরিতে আর আমার যোগ দেওয়া হলো না। এখনও মনে পড়ে, সৌজন্যতাবোধের বাধায় সেই কর্মকর্তার টেবিলের ওপর থেকে সিভিটা নিয়ে আসতে পারিনি, পরে এজন্য নিজের প্রতি খুব জেদ হয়েছে। তখন সিভি প্রিন্ট করার টাকা যোগাড় করাও কষ্টের ছিল।
ব্যতিক্রমী ঘটনা ৩: আমার একটি কর্মস্থলে পুরনো কর্মস্থলের একজনকে চাকরি দেওয়া হলো আমাদের আরেকজন জেষ্ঠ্য সহকর্মীর সুপারিশে। কিছু দিন পর অফিসের প্রশাসনিক শাখা থেকে জানানো হলো তার বিরুদ্ধে অফিসের টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে। পরে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হলো। এ ঘটনার পর যার সুপারিশে চাকরি হয়েছে তিনি আমার সঙ্গে আলাপে জানালেন, এই ছেলেকে তো এমন মনে হয়নি আগের প্রতিষ্ঠানে। শেষ মেষ আমার অনুমান, সেটি ছিল ছেলেটিকে বিপদে ফেলার ফাঁদ।
ঘটনা ৪:
ফেনীর একজন সিনিয়র সাংবাদিকের অনুরোধে ঢাকায় একটি ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকের সাক্ষাৎকার নিতে গেলাম ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষে ব্যক্তিগত আলাপের একপর্যায়ে তিনি জানালেন বৃটিশ আমালে কাউকে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্র চাকরিপ্রার্থীর বাবা, দাদার খবর নিতো। তাদের অতীত ইতিহাস ইতিবাচক পাওয়া গেলে সেই বিবেচনায় চাকরি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতো।
এসব ঘটনা একটু বিশ্লেষণের চেষ্টা করা যাক। প্রথম ঘটনায় দুইবাইয়ের মতো উন্নত জায়গায় পাঁচ তারকা রেস্তোরাঁয় চাকরি করা ব্যক্তি রেফারেন্স কী জিনিস জানেন না। সেখানে নিশয়ই বহু জনবল নিয়োগ হয় এই রেফারেন্স পদ্ধতি ছাড়াই। দ্বিতীয় ঘটনায় আমার যোগ্যতা ছিল, রেফারেন্স কোনো মতো হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ টাকার বনিবনার জন্য চাকরি হয়নি। তৃতীয় ঘটনায় রেফারেন্সে চাকরি হয়েছে। আমার অনুমান সত্যি হলে ছেলেটি নিরপরাধ, ফাঁদে পা দিয়ে চাকরি হারিয়েছে। আর অনুমান সঠিক না হলে সে তার নৈতিকতার দায় নিয়েই চাকরি থেকে সরে যেতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো রেফারেন্সে তার চাকরি হওয়া সঠিক নাকি ভুল? চতুর্থ ঘটনা বৃটিশদের রেফারেন্স পদ্ধতি। বৃটিশরা কেনই বা এমন পদ্ধতি ব্যবহার করত, এর বিকল্প কি ছিল না? আমাদের দেশের মানুষ কি অতীত থেকেই নেতিবাচক চর্চায় অভ্যস্ত? যদি আমাদের দেশের মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কারণেই রেফারেন্স গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা উন্নতির পাল্লায় কিছু কি জমা হয়েছে? যদি হয়ে থাকে তাহলে সেই নমুনা কোথায়?
গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছি। সেখানে একজন বক্তা বললেন, আজীবন আমরা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে আসছি। আরেকজন বক্তার প্রশ্নের জবাবে দর্শক-শ্রোতারা জানালেন আমরা অশান্তির দুনিয়ায় বসবাস করছি।
নতুন বাংলাদেশ বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার আওয়াজ উঠেছে। আর এমন সমাজ সেদিনই বাস্তবায়ন হবে যেদিন আমরা রেফারেন্সমুক্ত চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারব। তাহলে এমন একটি সমাজ হবে যে সমাজের কেউ কাউকে রেফারেন্স দিতে হবে না। সবাই সবার। বুক চেতিয়ে বিশ্বের বুকে উদাহরণ হবে বাংলাদেশ। এমন অনেকগুলো বাংলাদেশ নিয়ে গড়া হবে একটি বিশ্ব। নতুন বাংলাদেশের মতো সেই বিশ্বের নাম হতে পারে ‘রেফারেন্সমুক্ত পৃথিবী’।
নোট: কারো কাছে রেফারেন্সমুক্ত দুনিয়া গড়ার ভালো ফর্মুলা থাকলে বলতে পারেন, জানতে আগ্রহী।
#
ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, সকাল ৯টা: ১৭ মিনিট

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button