জেফারের শাড়ি পরা এবং ডিজিটাল সাংবাদিকতার বয়ঃসন্ধিকাল
মাহফুজ রহমান :
ঈদের আগে একেক পেশাজীবীর একেক রকমের প্রস্তুতি থাকে। সংবাদপত্রের ফিচার বিভাগ, বিশেষ করে লাইফস্টাইল সাংবাদিকেরাও এক রকমের প্রস্তুতি নেন—ট্রল হজমের প্রস্তুতি। কারণ, ঈদের আগে ‘তারকা সাজ’–জাতীয় বিভাগে কমপক্ষে ৪–৫ জন তারকাকে পাঠকের সামনে হাজির করবেন তাঁরা। আর তা করা মাত্রই কেউ কেউ ফিচারটা শেয়ার করে লিখবেন এ রকম কিছু মন্তব্য—
১. ঈদে তো আমিও শাড়ি/লুঙ্গি পরব; কই, আমারে নিয়া তো লেখা হইল না!
২. আমি কি খালি গায়ে থাকুম?
৩. এরা আর তারকা পায় না, যতসব *** নিউজ!
৪. ও শাড়ি/লুঙ্গি পরবে তো আমার কী!
৫. এই খবরের সংবাদমূল্য কী?
এবং ইদানীং কেউ কেউ অবধারিতভাবে লিখবেন—
৬. এইটা আবার কে? এরে তো চিনি না!
আজ প্রথম আলোর ‘জীবনযাপন’ বা ‘লাইফস্টাইল’ সেকশন থেকে একটা ফিচার উঠেছে। শিরোনাম—‘ঈদে শাড়ি পরবেন জেফার’। অনুমিতভাবেই কেউ কেউ তা শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখছেন ওপরের মন্তব্যগুলো। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু ‘দেশের মানুষ ভাত পায় না, আর তরা আছস অমুক লইয়া’–জাতীয় কমেন্ট করা আমজনতা প্রসঙ্গে বলছি না। বরং ‘সচেতন’ ব্যক্তির মন্তব্যই আলোচনার বিষয়।
মোটা দাগে তিনটা মন্তব্যের উত্তর খোঁজা যাক—
১. ঈদে তো আমিও শাড়ি/লুঙ্গি পরব; কই, আমারে নিয়া তো লেখা হইল না!
এক কথায় উত্তর—কারণ, আপনি তারকা নন। তারকা কী পরে, কী খায়, কী ভাবে, কোথায় ঘুরতে যায়, কোথায় চুল কাটায়, কীভাবে হাঁটে, কীভাবে কান খোঁচায়—এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের তুমুল আগ্রহ। একেক মানুষ আবার একেক অঙ্গনের তারকার ভক্ত। কে কোন তারকাকে ফলো করবে, তা নির্ভর করে তার আগ্রহের বিষয়ের ওপর। জেফার চলতি প্রজন্মের তারকা। তিনি কেমন গান, কেমন অভিনয় করেন, তা এখানে আলোচ্য নয়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফ্যান–ফলোয়ার কত, তা চট করে সার্চ করলেই জানা যাবে। তবে সব মিলিয়ে উত্তর হলো, তিনি তারকা। তিনি গায়িকা, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক; এই ঈদে চরকির জন্য বানানো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘মনোগামি’ সিনেমায় অভিনয় করেছেন; তাঁর সহশিল্পী চঞ্চল চৌধুরী। জেফার মডেলিং করেন। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘লাভজেন’–এর বাংলাদেশ অংশের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন ২০২১ সালে।
২. আমি কি খালি গায়ে থাকুম?
হ্যাঁ, চাইলে আপনি ঈদের দিন খালি গায়ে থাকতেই পারেন। উদোম গায়ের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে অশেষ লাভ–লাইকও হাসিল করতে পারেন। তবে জেফার শাড়ি পরলে, তা নিউজ বটে। কেন? কারণ, ক্যারিয়ারের শুরুতে জেফারের লুক ছিল এক রকম, এখন আরেক রকম। ক্যারিয়ারের শুরুতে তিনি শাড়ি পরতেন না। তাঁর পোশাক ছিল ওয়েস্টার্ন। তাঁর চুল ছিল অন্য রকম। জেফার পপ মিউজিক করেন বলে সচেতনভাবেই ওই লুক নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সম্প্রতি লুকে আমূল পরিবর্তন এনেছেন। চুল তুলনামূলক ছোট এবং স্ট্রেট করে ফেলেছেন, মেকআপ হয়েছে সফট এবং বড় কথা হলো তিনি শাড়ি পরছেন। জেনজি ভক্তরা জেফারের এই সাম্প্রতিক লুক নিয়ে আগ্রহী। কেবল কি পাঠক আগ্রহী? উঁহু, বিজ্ঞাপনদাতারাও সমান সমঝদার।
৩. এই খবরের সংবাদমূল্য কী?
একটা বড় পাঠকশ্রেণি যখন কোনো বিষয়ে আগ্রহী, তখন তা খবর হিসেবে পরিবেশন করা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। জেফার যদি শুরু থেকে নিয়মিত শাড়ি পরতেন, তাহলে শিরোনাম এমন হতো না। আজকে যদি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ঈদের দিন শার্ট পরেন, তাহলে শিরোনাম হবে ‘ঈদে শার্ট পরবেন বন্যা’। সিম্পল। এ কারণে জেফারের খবরটার সংবাদমূল্য আছে। এবং আমি বিশ্বাস করি, ‘ঈদে শাড়ি পরবেন জেফার’ শিরোনামটা পারফেক্ট। এই শিরোনাম যে কারোরই অপছন্দ হতে পারে। তবে আমার আলোচনার বিষয় সেটা না। আর এই শিরোনাম কেন ‘পারফেক্ট’ বা ‘ইফেক্টিভ’, তার ব্যাখ্যা পরে দিচ্ছি।
খ.
এবার আসি ডিজিটাল সাংবাদিকতা নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি প্রসঙ্গে। শুধু দেশের না, গোটা দুনিয়ার ডিজিটাল সাংবাদিকতাই বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে। বুকে হাত দিয়ে কেউ–ই বলতে পারবে না, আমরা ডিজিটাল সাংবাদিকতার নাড়িনক্ষত্র উদ্ধার করে ফেলেছি। অর্থাৎ সবাই প্রতিনিয়ত পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শুধু কি সাংবাদিকতা? আমি তো মনে করি, দুনিয়ার ইন্টারনেট সার্ভিস ইউজারদের বড় একটা অংশ এখনো এই লাইনে আনাড়ি। কেউই ঠিক হলপ করে বলতে পারে না কিংবা জানে না, কী করিলে কী হইবে। সাংবাদিকেরা যেহেতু মানুষ, আর দশজন পেশাজীবির মতো, ফলে ভুলচুক করাই স্বাভাবিক। তবে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছেই। ‘ঈদে শাড়ি পরবেন জেফার’ শিরোনামটা কেন প্রাসঙ্গিক, তার ব্যাখ্যা দিয়েছি। কেন ইফেক্টিভ বা লাভজনক, তা বলি এবার। এখানে ক্লিশে শিরোনাম দিলে বেশির ভাগ পাঠকই আমলে নিতেন না। যেমন ‘ঈদে কেমন হবে জেফারের সাজপোশাক’ কিংবা ‘ঈদে কী পরবেন জেফার’ অথবা ‘জেফার এবার ঈদ কাটাবেন কীভাবে’—এসবই ক্লিশে শিরোনাম। অথচ দেখুন, ‘ঈদে শাড়ি পরবেন জেফার’ শিরোনামটা দিয়ে তিন শ্রেণির পাঠকের অ্যাটেনশন গ্র্যাব করা গেল। একটা শ্রেণি হলো জেফারের ফ্যান–ফলোয়ার; এঁরা জেফারের কিছু দেখলেই পড়বেন। দ্বিতীয়টা হলো কৌতুহলী পাঠকশ্রেণি। এই শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত তাঁরা, যাঁরা জেফারকে চিনতে চান; তাঁরা দেখতে চান কে এই নতুন প্রজন্মের তারকা; কেন তাঁর শাড়ি পরার খবরটা গণমাধ্যমে সংবাদ হলো? আর তৃতীয় শ্রেণির পাঠক হলেন তাঁরা, যাঁরা ওপরের মন্তব্যগুলো করেছেন।
গ.
এই পাঠকশ্রেণি সম্পর্কিত আমার টাটকা অভিজ্ঞতার কথা বলি। গতকালকের কথা। ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে একজনের পোস্ট দেখে থামলাম। তাঁর বক্তব্য হলো, সংযুক্ত আরব আমিরাতের জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর খালিদ আল আমেরি ও সালামা মোহাম্মদের বিচ্ছেদ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। সত্যি বলতে, আমি কখনো খালিদ–সালামার কন্টেন্ট আগ্রহ নিয়ে দেখিনি। তবে ফ্রেন্ডলিস্টের একজন যখন বিষয়টা নিয়ে এত বিমর্ষ, তখন ওদের কন্টেন্ট দেখলাম। এবং বিকেলে অফিসে একজন সহকর্মীও খালিদ–সালামাকে নিয়ে লেখা যায় কি না, তা জানতে চাইলেন। এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে বললাম, ‘লেখেন।’ ওই লেখার ভিউ কত হয়েছে, জানেন? প্রায় এক লাখ! এটার আরও ভিউ হবে। তো এখন বলেন, আমি যদি খালিদ–সালামাকে ‘চিনি না’ বলে ইগনোর করতাম, আখেরে তা কতটা ভালো হতো? আপনার ফ্রেন্ডলিস্টের সবাই হয়তো কাবাডি খেলার ভক্ত, তাঁরা হয়তো কাবাডি বাদে আর কোনো কিছুতে ততটা ইন্টারেস্টেড নন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের মধ্যে দুয়েকজন অচেনা অঙ্গনের এক তারকার নিউজ শেয়ার করে লিখতে পারেন, ‘এরে তো চিনি না!’ তো আপনি তাহলে আপনার ফ্রেন্ডলিস্টের দুয়েকজনের মন্তব্য অনুযায়ী পুরো বিষয়টা জাজ করে ফেলবেন? এটা কি আদৌ সুবিবেচনা হবে?
ঘ.
এই ‘চিনি না’ প্রসঙ্গে অনেকেই ব্রাত্য রাইসুকে টেনে আনেন। কেন? কারণ, তিনি আজকে অমুক বিখ্যাতকে চেনেন না, কালকে তমুক বিখ্যাতকে চেনেন না। আমার ধারণা, এই চেনা না–চেনার বিষয়টা রাইসু ভাইয়ের স্ট্র্যাটেজি। যাহোক, তিনি তো তা–ও হাতে গোনা দুই–তিনজনকে ‘চিনি না’ বলেছেন। কিন্তু আমি তো দেখি, প্রায় কাউকেই চেনে না, এমন লোকের সংখ্যা বেশি! এরা সারাক্ষণই ‘এরে চিনি না ওরে চিনি না’ করতে থাকে! না চেনা না জানায় দোষের কিছু নাই। তবে এটা তো আমরা জানি, মানুষের বিকাশ, বিবর্তন হয়েছে অজানাকে জানতে গিয়ে। এখন কেউ যদি কাউকে চিনতে না চায়, কিছু জানতে না চায়, সেটা তার বিষয়। কেউ স্বেচ্ছায় বা স্রোতে গা ভাসিয়ে যদি বিবর্তনের উল্টা দিকে যেতে যায়, তখন কীই–বা করা যাবে! তবে না চেনা–জানায় গৌরবের কিছু নাই।
কথায় কথায় আমার স্ত্রী একবার বলেছিলেন, ‘তুমি কেন ফেসবুকে অচেনা–অজানা লোককে অ্যাড করো?’ উত্তরে যা বলেছিলাম, তার সারমর্ম হলো, মানুষ কী শেয়ার করছে, তা জানা আমার কাছে অতিজরুরি। আমি অনেক কিছুই চিনি না, জানি না, বুঝি না। আমার লিস্টের লোকজন প্রতিদিন এমন অনেক কিছুই শেয়ার করেন, যা আমাকে ঋদ্ধ করে। বাস্তবের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সারাদিন কাটালেও আমি হয়তো সেসব জানতে পারতাম না। কারণ, আমার বন্ধুরা তো অনেকটা আমার মতোই। ওদের ইন্টারেস্ট আমার ইন্টারেস্ট প্রায় কমন। তাই শেষমেশ এটাই বলি, হে ফেসবুক ফ্রেন্ড, আপনার জন্য ভালোবাসা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে?/ অচেনাকেই চিনে চিনে/ উঠবে জীবন ভরে।।/ জানি জানি আমার চেনা/ কোনো কালেই ফুরাবে না,/ চিহ্নহারা পথে আমায় টানবে অচিন ডোরে।।/ ছিল আমার মা অচেনা, নিল আমায় কোলে…’।
(ডিসক্লেইমার: এই লেখা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির উদ্দেশে নয়। কোনো প্রতিষ্ঠানের হয়ে জবাবদিহিমূলক বিবৃতিও নয়। একজন সাংবাদিক হিসেবে ডিজিটাল সাংবাদিকতার বাঁক বদল নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির একটা অংশ মাত্র।)