রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার অন্তরালে চরম বৈষম্য: বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
ডা. এম. জি. মোস্তফা মুসা

সাম্প্রদায়িকতার অন্তরালে:
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বহুমাত্রিক চর্চা, বিশেষ করে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, দেশকে চরম বৈষম্যের গভীরে ঠেলে দিয়েছে। এই বৈষম্যের ছত্রছায়ায় সরকারী সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় দেশের ধনসম্পদ লুটপাট করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, এবং নিরপরাধ মানুষের উপর জেল-জুলুম ও অন্যায় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তাদের এই অন্যায় কার্যক্রমের ফলে দেশের সম্পদ বিপুল পরিমাণে বিদেশে পাচার হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং জাতিকে এক গভীর সংকটের দিকে নিয়ে গেছে। বর্তমান প্রবন্ধে বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায়, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা, এবং রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই-আগষ্ট-২৪ বিপ্লব নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক আলোচনা করা হয়েছে।
২. বৈষম্য বলতে কি বুঝায়:
বৈষম্য বলতে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বা সমাজের একাংশের প্রতি অন্যায় আচরণ, অসম বণ্টন, বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া বোঝায়। বৈষম্য তখনই ঘটে যখন কোনো ব্যক্তিকে তার ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, বা অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে অবমূল্যায়ন, অসম্মান বা অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। সাধারনত সরকারের ছত্রছায়ায় এই সকল বৈষম্য ও বঞ্চনা সংঘটিত হয়। বৈষম্যের প্রধান লক্ষণগুলো হলো:
২.১ সুযোগ বা সুবিধার অসম বণ্টন: কিছু মানুষকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, অন্যদিকে অন্যদের সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
২.২ কঠোর আচরণ বা শাস্তি: বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় বেশি কঠোর শাস্তি পায়। অন্যদিকে দাগী আসামি ও অপরাধি ছাড়া পেয়ে যায় ।
২.৩. মানবাধিকার হরণ: কোনো গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে তাদের ন্যায্য অধিকার বা সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বৈষম্য সমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এটি ব্যক্তি, সমাজ, এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সামগ্রিকভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
৩. সাম্প্রদায়িকতা বুলতে কি বুঝায়:
সাম্প্রদায়িকতা বলতে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়, জাতি, গোষ্ঠী এবং ধর্মের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ, বিদ্বেষ বা ঘৃণা প্রদর্শন করা বোঝায়। এটি মূলত তখন ঘটে যখন কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজ সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা প্রভাবশালী মনে করে এবং অন্যদের অধিকার, মর্যাদা বা সুরক্ষা ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করে।
সাম্প্রদায়িকতা সামাজিক, রাজনৈতিক, বা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উদ্ভূত হতে পারে এবং এটি বিভেদ, সহিংসতা, এবং বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়। সাম্প্রদায়িকতার ফলে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা সমাজের স্থিতিশীলতা ও শান্তিকে বিনষ্ট করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি জাতি, গোষ্ঠী যদি অন্য একটি জাতি-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি, আচার, আচরণ এবং ধর্মীয় চর্চা বা বিশ্বাসকে হেয় জ্ঞান করে, তাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা চালায় বা তাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করে, সেটিকে সাম্প্রদায়িক আচরণ বলা হয়।
৪. ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায়:
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বলতে বোঝায় যখন কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ধর্মের ভিত্তিতে অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের অনুসারীদের প্রতি বিদ্বেষ, ঘৃণা, বা বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এটি একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বা একমাত্র সঠিক মনে করে এবং অন্যদের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করে।ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য:
৪.১ বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব: অন্য ধর্ম বা বিশ্বাসের লোকদের প্রতি অবজ্ঞা, অবিশ্বাস, এবং বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করা।
৪.২ বৈষম্য: ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে লোকদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা, যেমন—কর্মসংস্থান, শিক্ষা, বা সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা।
৪.৩ সহিংসতা: ধর্মীয় ভিত্তিতে সংঘর্ষ, হামলা, এবং দাঙ্গা সৃষ্টি করা, যা সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ণ করে।
৪.৪ অসাম্য সৃষ্টি: ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক অসাম্য তৈরি করে।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা একটি সমাজে সামাজিক ঐক্য ও শান্তির জন্য বড় হুমকি, কারণ এটি মানুষের মধ্যে সন্দেহ, ঘৃণা, এবং বৈষম্যের বীজ বপন করে।
৫. রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায়:
রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা বলতে বোঝায় যখন কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব দলীয় সদস্যদের, সমর্থকদের, বা আদর্শগতভাবে সহমত ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করে এবং অন্য দল বা গোষ্ঠীর সমর্থকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। এটি একটি বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং অন্যদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে সমাজে বিভেদ ও অস্থিরতা তৈরি করে।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার যে প্রক্রিয়ায় অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, যেমন চাকরির ক্ষেত্রে তাদের বঞ্চিত করা, এটিকে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার একটি জলন্ত উদাহরণ।
এ ধরনের আচরণ রাষ্ট্রের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর। যখন একটি সরকার রাজনৈতিক ভিত্তিতে নাগরিকদের অধিকার ও সুযোগকে সীমিত করে, তখন তা সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ধরনের রাজনৈতিক বৈষম্যমূলক নীতি কেবল সমাজে বিভেদ বাড়ায় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্থিতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
তাই, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত, যাতে দেশের সকল জনগণ একসাথে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশে গত ৫০ বছর ধরে রাজনৈতিক সাস্প্রদায়িকতা প্রাকটিশ করা হয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য বৈষম্যের অন্যতম কারণ! রাজনৈতিক বৈষম্যের অন্তরালে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িতকার হুজুগ তুলে দেশে বৈষম্যের আড়ালে রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ধন-সম্পদ লুট করেছে!
৬. ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থ বিক্রি:
দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থ বিক্রির বিষয়টি বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্য শুধু দেশের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা আন্তর্জাতিক প্রভাব ও বিদেশী প্রভুদের বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতাকে আরও গভীর করে তুলেছে। দেশের শাসকগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এবং জনগণের বৈধ দাবিগুলোকে দমিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বহিরাগত ভারত শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে।
এই নির্ভরশীলতা তাদের বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট রাখতে বাধ্য করেছে, যার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা ভারতের স্বার্থের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। শাসকগোষ্ঠী দেশের জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এবং রাজনৈতিক সুবিধার জন্য দেশে জুলুম, নির্যাতন, শোষণ, গুম, খুন ও হত্যা চালিয়েছে। তারা জনগণকে দাসত্বের ফাঁদে ফেলে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ভারত নামক বিদেশী প্রভুদের কাছ থেকে অনৈতিক সমর্থন এবং অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেছে।
এভাবে, দেশের সম্পদ যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ, অর্থনৈতিক সংস্থান, এমনকি মানব সম্পদও বিদেশী স্বার্থের অধীনে চলে গেছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের সুবিধার জন্য দেশের ভবিষ্যতকে ভারত নামক বিদেশী প্রভুদের কাছে বন্ধক রেখেছে, যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ণ করেছে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
এই প্রক্রিয়ার ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে, এবং রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এক ধরনের দাসত্বে পরিণত হয়েছে, যেখানে দেশের জনগণ শুধুমাত্র শাসকগোষ্ঠী ও তাদের বিদেশী সহযোগীদের স্বার্থরক্ষার জন্যই ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য জনগণের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
৭. রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা লালনে ধর্মীয় দলগুলোকে বলির পাঁঠা বানানো:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা লালন করা একটি প্রচলিত কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে, ইসলামী দলগুলোকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে তাদেরকে সমাজে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘ ২০ বছরের শাসনামলে, (১৯৯৭-২০০১ এবং ২০০৯-২০২৪) এই প্রবণতা লক্ষ্যণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও ইসলামী দলগুলো কখনোই সন্ত্রাস বা জঙ্গী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল না, তবুও রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাহবা কুড়ানোর উদ্দেশ্যে, সরকার এই দলগুলোর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে, শত শত ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে ফাঁসির মুখে ঠেলে দিয়েছে এবং সামাজিকভাবে তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, আওয়ামী লীগ সরকার ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নাম করে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা লালন করেছে, যা কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং এতে দেশের সম্পদ লুটপাটের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে এবং বিরোধী দলের সমর্থকদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়েছে।
দ্বিমুখী নীতি এবং সামাজিক বৈষম্য: আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে একটি দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। একদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পেতে ইসলামী দলগুলোর উপর কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সরকার কখনোই অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ওপর আক্রমণ করেনি; বরং সবক্ষেত্রে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। এই বৈষম্যমূলক নীতি রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, যেখানে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে দমন করার মাধ্যমে অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে ।
উপসংহারে বলা যায়, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা লালন করা দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এই ধরনের কার্যকলাপ দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপর্যস্ত করেছে এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে মানুষের প্রতি অবিচার করেছে। সরকারের এই ধরনের পদক্ষেপ দেশের সামাজিক সম্প্রীতি এবং ধর্মীয় সমতা বজায় রাখার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। এখন সময় এসেছে, দেশের জনগণ এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সোচ্চার হবে, যাতে একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ ও সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
৮. রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিপ্লব (জুলাই-আগষ্ট-২৪ বিপ্লব):
রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যখনই রাজনৈতিক বৈষম্য এবং সাম্প্রদায়িকতা তীব্র হয়ে উঠেছে, তখন ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ বারবার এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং ন্যায়বিচার ও সমতার দাবিতে সোচ্চার হয়েছে।
৮.১_১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—এসব আন্দোলন প্রমাণ করে যে, যখন কোনো শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে জনগণকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে, তখন ছাত্র-জনতা দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই বিপ্লবী চেতনা সুস্পষ্ট।
৮.২ আবার, নব্বই দশকের গণআন্দোলন যা সামরিক শাসনের পতন ঘটিয়েছিল, তাতেও ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণ একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসতে পেরেছিল।
৮.৩ রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা: তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের প্রভাব নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ, বিরোধী দলের সমর্থকদের প্রতি দমন, পীড়ন, নিপীড়ন এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ অবস্থায় ছাত্রসমাজ ও সাধারণ জনগণের রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে; জুলাই-আগষ্ট-২৪ এর বিপ্লব সফল হয়েছে।
রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার বিপ্লব শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং একটি সমতাপূর্ণ, ন্যায়বিচারপূর্ণ, এবং গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। জনগণ এখন বিপ্লবী সরকারের সাফল্যের দিন গণনা করছে।
৯. উপসংহার:
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতার চর্চা, দেশের জন্য গভীর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতার এ চর্চা শুধুমাত্র সমাজের ভাঙন ঘটায়নি, বরং দেশকে অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং নৈতিকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে।
রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা দেশে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের স্বার্থে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য ও অত্যাচার চালিয়ে গেছে। এই বৈষম্যের মাধ্যমে তারা নিজেদের ক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য সাধারণ জনগণকে দমিয়ে রেখেছে এবং সুযোগ নিয়ে দেশের সম্পদ লুট করেছে। এছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জেল, জুলুম, এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধগুলোও এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফলাফল হিসেবে ঘটেছে।
এমন পরিস্থিতিতে, দেশের মূল্যবান সম্পদ বিদেশে পাচার করে তারা জাতির অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। এই ধরনের রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা দেশের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে এবং জাতিকে চরম সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এখন সময় এসেছে যে, দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, এবং সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে। শুধুমাত্র তখনই বাংলাদেশ তার পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে এবং একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।
(মূসা: ২৯-০৮-২৪)